সেই মন্দির । ছবি: প্রতিবেদক।
কাঁচরাপাড়ার রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সার্বিক পর্যটন-আকর্ষণ বাড়াতে চায় কল্যাণী পুরসভা। ঠিক এই আদলের রথ এ রাজ্যে একটিই। ৯ দিনের মেলা দেখভালে তৈরি হয়েছে নয়া কমিটি। সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী মন্দির চত্বরে স্থাপিত হবে রাসায়নিক তন্তুর তৈরি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মূর্তি। উচ্চতা বেদি-সহ ১১ ফুট।
এই রথকে ঘিরে রয়েছে নানা কাহিনি। কিন্তু কী ভাবে এটিকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যটন-মানচিত্রের মানোন্নয়ন সম্ভব? কল্যণী পুরসভার চেয়ারম্যান সুশীল তালুকদার বলেন, ‘‘পুরী তো বটেই, এ রাজ্যে মাহেশ, গুপ্তিপাড়ার মতো এলাকাগুলিও রথযাত্রার জন্য পরিচিত। কিন্তু কাঁচরাপাড়ার রথের ঐতিহ্য রাজ্যে অনেকের জানা নেই।’’ ঠিক ১০ বছর আগে পুরসভা এই মেলার দায়িত্ব নেয়। এর পর থেকে এই রথের মেলা এই গোটা অঞ্চলের জনসংযোগের একটা প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
রথতলার এই মন্দির তৈরি হয় ১৭৮৫ সালে। শ্বেতপাথরের ফলকে আবছা লেখায় খোদিত কলকাতা নিবাসী নিমাইচরণ মল্লিক ও গৌরচরণ মল্লিক। প্রাচীরঘেরা চত্বরে আটচালা ঘরানার প্রায় ৬০ ফুট উঁচু মন্দির। বিভিন্ন অংশে টেরাকোটার কাজ। খোলা থাকে সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। মাঝে ১২টা থেকে ৪ ঘন্টা বন্ধ। এখন এই মন্দির দেখভালের প্রধান দায়িত্ব জগন্নাথ মুখোপাধ্যায়ের হাতে। তিনি জানান, রথযাত্রার দায়িত্ব সাহাগঞ্জের নন্দী-পরিবারের। মেলা পরিচালনার দায়িত্ব কল্যাণী পুরসভার।
যে মন্দিরকে ঘিরে এই রথযাত্রা, ২৩০ বছরের সেই প্রাচীন শ্রীকৃষ্ণ জিউ মন্দিরটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে কল্যাণী পুরসভার সাম্প্রতিক ওয়েবসাইটে। স্থানীয় (২০ নম্বর ওয়ার্ড) পুরপিতা সুব্রত চক্রবর্তী জানান, ‘‘কাঁচরাপাড়া এবং সংলগ্ন অঞ্চলে বেশ কিছু ঐতিহ্য আছে। এগুলোর কথা জানাতে এবার একটা টেবিল ক্যালেন্ডারও করেছি।’’ তিনি বলেন, রথযাত্রা যত জনপ্রিয় হবে, এটা দেখার টানে লোকে এসে স্থানীয় ঐতিহ্যগুলি দেখার সুযোগ পাবেন।
আগে রথ এবং উল্টোরথ— মেলা বসত দু’দিন। পুরসভা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মেলা চলে ৯ দিন। রথযাত্রা উপলক্ষে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর যে মূর্তি স্থাপিত হবে, সেটি তৈরি করেছেন কৃষ্ণনগরের এক শিল্পী। তাঁর পারিশ্রমিক, মূর্তি বহন এবং স্থাপনের খরচ, আলোক— সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা খরচ হবে। পুরী যাওয়ার পথে মহাপ্রভু এসেছিলেন এখানে। ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব দিয়ে যান পারিষদ শিবানন্দ সেনের উপর। আপাত-অজানা এই তথ্য এই মূর্তির মাধ্যমে সমবেতদের জানানোর চেষ্টা হবে।
ঐতিহ্যের এই রথ চালুর নেপথ্যে রয়েছে হুগলির সাহাগঞ্জের এক জমিদার পরিবারের পুত্রসন্তান লাভের স্বপ্ন। ওই স্বপ্ন পেয়ে চালু হয় এই রথযাত্রা। পরিবারের বর্তমান শরিক আশিস নন্দী এ কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘ইস্পাতের তৈরি এই রথটির বয়স ২০০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। আমাদের এক পূর্বপুরুষ এটি তৈরি করান কাঁচড়াপাড়া রেল কারখানায়। তার আগে এখানে চলত কাঠের রথ। ঠিক কবে এর উৎস, কেউ জানেন না।’’ তিনি বলেন, এই রথে কিন্তু জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার বিগ্রহ থাকে না। থাকে বলরাম আর কৃষ্ণ। মন্দির থেকে প্রথমে বলরামকে তোলা হয় রথে। মন্দিরে পাথরের কৃষ্ণকে না সরিয়ে (কেষ্টরাই জিউ) তাঁর একটি প্রতীকী কাঠের মূর্তি পাল্কি করে মন্দির থেকে আনা হয় রথে। আগে এই রথ যে পথে যেত, এখন সেই পথ বদল হয়েছে। এবার রথটি রং করা হচ্ছে।
জনশ্রুতি, ফি বছর রথযাত্রার সময়ে কাঁচরাপাড়ার পাথুরে কৃষ্ণ নাকি ঘামতে থাকেন। এর পৌরাণিক কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আশিসবাবু বলেন, মহাপ্রভু-অনুগামী শিবানন্দ সেন ছিলেন চিকিৎসক। তিনি একবার দিল্লির নবাব পরিবারে যান। আগ্রার কেল্লার এক অংশ থেকে স্বপ্নদ্রষ্ট পাথর নিয়ে যেতে চান। নবাবের অনুমতি পেয়ে কেল্লার সেই অংশে গিয়ে সেরকম পাথর আর খুঁজে পান না! ফের স্বপ্নে নির্দেশ পান, ওই অংশে যেটি ঘামছে, সেটিই উদ্দিষ্ট পাথর। সেই সঙ্গে দেব-নির্দেশ পান ওই পাথর যমুনার জলে ফেলে দিতে হবে। নির্দেশ পালন করেন শিবানন্দ সেন। সেই পাথর ভাসতে ভাসতে এসে ওঠে এখানে গঙ্গার ঘাটে।
তবে এই কাহিনীর সত্যি-মিথ্যা বিচারের দায় নেই কারও। ৮ চাকার এই রথ, ৯ দিনের মেলা, মেলার বিকিকিনি আর খাওয়া-দাওয়া —এই সব কিছু নিয়েই এখন ব্যস্ততা তুঙ্গে কাঁচরাপাড়ার রথতলায়।