প্রতীকী ছবি।
কোভিড-অতিমারির কারণে রাজস্থান সরকার দীপাবলির আতশবাজি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। ১০ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে বাজি নিষিদ্ধ করেছে ওড়িশা সরকারও। কিন্তু কালীপুজোতে বাজির ব্যবহার নিয়ে এখনই তেমন কড়া অবস্থান নিল না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বরং চলতি পরিস্থিতিতে বাজি ব্যবহার না-করার বিষয়টি আমজনতার ‘মানবিকতার’ উপরেই ছেড়েছে রাজ্য।
মঙ্গলবার কালীপুজোর প্রস্তুতি, বিসর্জন এবং আতশবাজির ব্যবহার— এই তিনটি বিষয়ে প্রশাসন এবং পুলিশের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে সরকারের অবস্থান জানিয়ে দেন রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীপুজোর মণ্ডপ তৈরি এবং বিসর্জনের ক্ষেত্রে কিছু বিধি অবশ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
আলাপনবাবু বলেন, “মানুষ, ক্লাব, পুজো কমিটি, প্রশাসনের সহযোগিতায় দুর্গাপুজো যেমন সুন্দর ভাবে হয়েছে, তেমনই সকলের সহযোগিতায় বাজি এড়িয়ে সংযত ভাবে কালীপুজো এবং দীপাবলি পালন করতে হবে। অতিমারি চলছে। শ্বাস এবং অন্যান্য রোগের সমস্যা রয়েছে।
আরও পড়ুন: মেরুকরণের সঙ্গে তাস ‘জঙ্গলরাজ’, বিহার-সুর কি বঙ্গেও
অনেকে রোগী হাসপাতাল এবং হোম আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন। মানবিক দিক থেকে দেখে সকলেরই বোঝা কর্তব্য, এই সময় বায়ুদূষণ তাঁদের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। তাই সকলকে অনুরোধ করা হচ্ছে, কেউই বাজি পোড়ানোর দিকে যাবেন না। সুপ্রিম কোর্ট বা অন্যান্য বিচারে নিষিদ্ধ, মাত্রার উপরে থাকা বাজি ব্যবহার করবেন না। তার উপরেও আমাদের আবেদন কেউই যেন বাজির ব্যবহার না করি। বাজি এড়িয়ে চলব, তা থেকে বিরত থাকব। আমাদের আনন্দ যেন অন্যের নিরানন্দের কারণ না হয়।”
কালীপুজোর বিধি
• প্রতিমার মাথার উপর আচ্ছাদন থাকলেও মণ্ডপের চার দিক খোলা
• দর্শনার্থীদের কোভিড-স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ পুজো কমিটি এবং ক্লাব
• বিসর্জনে শোভাযাত্রা নয়
• প্রশাসন-পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে বিসর্জন পরিকল্পনা
অন্য দিকে বিভিন্ন বিশিষ্ট জনকে পাঠানো বিজয়ার শুভেচ্ছা-বার্তাতেও সংযম, সচেতনতার আর্জি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বার্তা, ‘সমাজের সকলে সচেতন ও শান্তিপূর্ণ ভাবে দুর্গাপুজো উদযাপন করেছেন। এই সহযোগিতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আসন্ন উৎসবগুলিতেও একই রকম সংযম, সতর্কতা এবং সচেতনতার আশা রাখি’। এ দিনই মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বাজি-নিয়ন্ত্রণে আর্জি জানিয়েছে চিকিৎসক এবং পরিবেশকর্মীদের একাধিক সংগঠন। চিঠিতে তাঁদের দাবি, বায়ু দূষণের মাত্রা ন্যূনতম বাড়লে সমান্তরাল ভাবে বাড়বে সংক্রমণের হারও।
আরও পড়ুন: বাগডোগরায় ডিএম, সিপি-র সঙ্গে কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী
তাই বাজি-নিয়ন্ত্রণে কড়া পদক্ষেপের আর্জিও জানিয়েছে সংগঠনগুলি। অনেকে মনে করেছিলেন, করোনা আবহে বাজি নিয়ে নির্দিষ্ট বিধি ঘোষণা করবে সরকার। যদিও পুলিশকর্তাদের অনেকেই জানাচ্ছেন, এ বছরও নিষিদ্ধ বাজি ধরতে অভিযান চলবে। নজরদারি থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি না করলে কি আমক্রেতার মধ্যে সেই সংযম থাকবে? পুলিশ-প্রশাসনের তরফে সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
বস্তুত, দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী পর্যন্ত ভিড় এড়াতে মানুষের সংযম থাকলেও, নবমী এবং দশমীতে তা আর চোখে পড়েনি। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ দেবকিশোর গুপ্ত বলেন, “চলতি বছরের পরিস্থিতি একেবারেই ব্যতিক্রমী। কালীপুজো বা দীপাবলির সময় শ্বাস-রোগের প্রবণতা এমনিতেই বাড়ে। ফলে কোভিড রোগী বা যাঁরা সবে সুস্থ হয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই সময়টা খুবই স্পর্শকাতর। বায়ু দূষণ বাড়লে তা এড়িয়ে থাকা তাঁদের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। তাই এই বছরটাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন ছিল।” বক্ষ রোগের চিকিৎসক রাজা ধরের কথায়, “আমাদের জনসংখ্যা এতটাই বেশি, তার মধ্যে ন্যূনতম শতাংশের মানুষ সচেতন না হলেই বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। ফলে মানুষকে সচেতন হতে বাধ্য করতে হবে। অথবা এমন বাজি নির্দিষ্ট করে দিতে হবে, যেগুলি তুলনায় নিরাপদ।”
তবে সরকারের অন্দরের বক্তব্য, বজ্র আঁটুনিতে ফস্কা গেরোর সম্ভাবনা থাকে। তাই চলতি অতিমারির কথা মনে করিয়ে দিয়ে ব্যক্তিগত মূল্যবোধের উপরেই গোটা বিষয়টা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, দুর্গাপুজোর সময়েও প্রশাসনিক বজ্রআঁটুনি রাখা হয়নি। তা-ও মানুষ কিছুটা স্বতঃপ্রণোদিত, কিছুটা আদালতের রায়ে বাধ্য হয়ে বিধি পালন করেছেন। তাই অতবড় উৎসব হয়ে গেলেও সংক্রমণের হার রাজ্যে বাড়েনি। মুখ্যসচিব বলেন, “সার্বিক ভাবে আক্রান্ত, মৃত ও সংক্রমণের হার কমায় আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়ছে। তবে পরিকাঠামো বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।”
এ দিন দুর্গাপুজোর মতো কালী পুজোর মণ্ডপ ব্যবস্থাপনাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে রাজ্য। প্রতিমার মাথার উপর আচ্ছাদন থাকলেও মণ্ডপের চার দিক খোলা রাখতে হবে। দর্শনার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সতর্ক এবং দায়বদ্ধ থাকতে হবে পুজো কমিটি ও ক্লাবগুলিকে। বিসর্জনে শোভাযাত্রা করা যাবে না। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিসর্জন পরিকল্পনা করতে হবে। মুখ্যসচিব বলেন, “দুর্গাপুজোর সময় সব ক্লাব এবং পুজো কমিটি এবং সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল, সেই সংযম এ বারও প্রত্যাশা করছে সরকার। উৎসব উৎসবের মতোই হবে। এ দিনের বৈঠকের পরে বিসর্জন-বাজি-প্যাণ্ডাল ব্যবস্থাপনায় যে বিধি তৈরি হল, তা প্রত্যেক পুজো কমিটির মেনে চলা উচিত।”