বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়
মাস ছয়েক আগে বাংলা বা ভারতের এক ঘোর বিপদের সময়ে তিনি সজাগ না-করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারত। ছ’মাস বাদে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের দাপটেও ভোট আয়োজন প্রক্রিয়ার ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতায়’ তিনিই যেন ভরসা অসহায় নাগরিকদের। অনেকের কাছেই বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় এখন সচেতনতা বা সুচেতনারই এক বিরল কণ্ঠস্বর।
মাস ছয়েক আগে পুজো নিয়ে রাজ্যে প্রভাবশালী কর্মকর্তা থেকে আমুদে পুজোপাগলদের উৎসাহে জল ঢালতে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের দুই বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবেই গোটা দেশের চোখ খুলতেও বিচারপতি সঞ্জীববাবুই বিশিষ্ট ভূমিকায়।
অথচ এ বছরের গোড়ায় মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের সময়েও বেশি উচ্চকিত বা কটুভাষী না-হয়েই তিনি নিজ ভূমিকায় কার্যকর হতে চান বলে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন। এর মাস চারেকের মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে তাঁকে কার্যত কঠোরতম মন্তব্য করতে হয়েছে, যা গোটা দেশেই তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। এখন ৬০ ছুঁই ছুঁই সঞ্জীববাবু কলকাতা হাই কোর্টের স্থানীয় বিচারপতি হয়েছিলেন ২০০৬ সালে। কলকাতা তথা গোটা দেশেরই একটি সম্ভ্রান্ত উকিল-জজসাহেবের পরিবারে তিনি জন্মেছেন। তাঁর পিতামহ আইনজীবী নলিনীচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপ্রিম কোর্টের প্রয়াত বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনি ভ্রাতুষ্পুত্র।
গত বছর বাঙালির সাধের দুর্গাপুজো দর্শকশূন্য ভাবে সারতে হবে বলে রায়টিও গোটা দেশেই সাড়া ফেলেছিল। অনেকেরই মত, পুজোর ঠিক আগে সময়োপযোগী ওই রায় ছাড়া বাংলার উপরে সংক্রমণের বিরাট বিপদ নেমে আসত। ওই সময়ে হাই কোর্টের আইনজীবী মহলে অনেকেরই মনে পড়েছিল দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ের কাছে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজোর কথা। অর্থাৎ, দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালির আবেগের শরিক হয়েও অতিমারিতে সমাজজীবনের বিপদে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে বিচারপতি পিছপা হন না। বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে কলকাতার হাই কোর্ট মহলও কিন্তু বরাবর তাঁর ‘অপ্রিয়’ কিন্তু সবার জন্য হিতকর সিদ্ধান্তের জন্যই চিনত। সমাজ জীবনে মেলামেশার ক্ষেত্রেও এই বিচারপতি আবার কড়া শৃঙ্খলার সঙ্গে নিজের চারপাশে এক ধরনের বর্ম রচনায় অভ্যস্ত। ক্যালকাটা ক্লাবের অন্তরঙ্গ পরিসরে তাঁকে দেখা গেলেও কেউই যেন সহজে কাছে ঘেঁষতে পারেন না।
কলকাতা হাই কোর্টের ১৬ নম্বর ঘরে এই জজসাহেবের ঘরে মামলা উঠলে রীতিমতো ভয় পেতেন অনেক দুঁদে আইনজীবীও। জনৈক প্রবীণ আইনজীবীর কথায়, “দেওয়ানি মামলা থেকে সংবিধান বিষয়ক ব্যাখ্যা, আইনের নানা ক্ষেত্রে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবাধ বিচরণ। কোনও রকম দুূর্নীতির ক্ষেত্রে তিনি সাংঘাতিক কঠোর। শুনানিতে ভুল করলেও তাঁর কাছে বকুনি খেতে হবে। কিন্তু দিনের শেষে তাঁর কাছেই সুবিচার মিলবে, এই আস্থাটাও অনেকের মধ্যে গড়ে উঠেছে।” এ যাত্রা, মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচন কমিশন বিষয়ে কঠোর পর্যবেক্ষণও আখেরে দেশের হুঁশ ফেরাবে বলেই অনেকে মনে করছেন।