মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের অপেক্ষায় জুনিয়র ডাক্তারেরা। — ফাইল চিত্র।
বুধবার দ্রোহের কার্নিভালের পর খানিকটা হলেও ঢিমে তাল দেখা গিয়েছিল ধর্মতলার অনশনমঞ্চ ঘিরে জনতার জমায়েতে। শনিবার বিকেলে পৌঁছে আবারও পুরনো জমজমাট ছবিটা দেখা গেল। দু’প্রান্তে দু’ভাগে চলছে স্লোগান। যেখানেই কান পাতা যায়, সরকার বা মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে আলোচনা। কেউ সমালোচনায় মুখর। কেউ বলছেন, ‘ছেলেমেয়েগুলোকে মারবে না কি’! কেউ বলছেন, ‘এ বার কেটে যাক বাবা সমস্যা’। একটা আশার পরিবেশ জমাট বাঁধছিল। তবে সেই ছবিটাও আবার বদলে গেল রাত ৮টা নাগাদ। যখন মুখ্যসচিবের ইমেলে আন্দোলনকারীদের সোমবার বৈঠকে যেতে বলা হল ‘অনশন প্রত্যাহারের পর’।
দুপুর দুটো নাগাদ ধর্মতলার মঞ্চে চলে যান মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী এবং কলকাতা পুলিশের ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। মুখ্যসচিবের ফোনেই অনশনকারী-সহ আন্দোলনরতদের কথাবার্তা হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথোপকথনের পরেই সাংবাদিক বৈঠক করেন অনশনরতরা। অনশনকারী স্নিগ্ধা হাজরা, সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা, রুমেলিকা কুমার ছাড়াও ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম মুখ দেবাশিস হালদার, আশফাকউল্লা নাইয়ারা। অনশনের চতুর্দশ দিনে শারীরিক অবস্থার কমবেশি অবনতি হয়েছে সকলেরই। তবে মনোবল এখনও অটুট। সকলে একযোগে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, চোখ থাকছে সোমবারের বৈঠকের দিকে। তার পরেও দাবি না-মানা হলে একই তীব্রতায় চলবে আন্দোলন।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হওয়ার পর জুনিয়র ডাক্তারদের কে কী বলেন?
স্নিগ্ধা হাজরা (অনশনকারী)
আজ অনশনের চতুর্দশ দিন। অনশনের এত দিন পেরিয়ে গেলে শারীরিক অবস্থা কেমন হয়, তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। পাশের বেডের অনশনকারী বন্ধু, সহকর্মীরা একে একে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে মানসিক অবস্থা কেমন হয়, তা-ও বুঝতেই পারছেন। আমরা প্রথম দিন থেকেই প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। আজ ১৪তম দিনে মুখ্যসচিব আমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথাও হয়েছে। সোমবার বিকাল ৫টার সময় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অমূল্য সময় যাতে নষ্ট না হয়, সে দিকে আমাদের নিশ্চয়ই নজর থাকবে। তাঁর একটুও সময় নষ্ট না করে আমাদের প্রতিনিধি দল যথা সময়েই সেখানে পৌঁছে যাবে। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগছে, আমাদের মুখ্যসচিব আর মুখ্যমন্ত্রী— দু’জনেই বারবার বললেন, অনশনের জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। অথচ আমরা মাত্র আট জন অনশনে বসে রয়েছি। আমরা হঠাৎ আন্দোলনে বসে যাইনি। ৭০ দিন আন্দোলনের পর প্রশাসনের সহযোগিতা না পেয়ে বাধ্য হয়েই অনশনে বসেছি। এমনকি, অনশনে বসার দিন সকালেও ডিউটি করে এসেছিলাম! আর মাত্র আট জন অনশনে বসেছি বলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে? ওঁরা বারবার বলছেন কাজে ফিরুন। আমরাও দ্রুত কাজে ফিরতে চাই। আমি ক্যানসার বিভাগে কাজ করি, এত দিন আমার রোগীদের মুখ না দেখে আমারও ভাল লাগছে না। অথচ নির্দেশিকা বার করার জন্য গত ১৪ দিন ধরে বসে থাকতে হচ্ছে, আমরা দুঃখিত। উনি দাবি মেনে নিন, আমরা এখনই কাজে ফিরব।
আলোলিকা ঘোড়ুই (অনশনকারী)
আজ মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব এলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে বার্তালাপ হল। বৈঠক তো আমরা প্রথম দিন থেকেই চেয়েছি। বারবার ইমেল পাঠিয়েছি, যখনই বৈঠকের ডাক দিয়েছেন আমরা ছুটে গিয়েছি। তার পরেও এ ভাবে ফোনে বার্তালাপ অনভিপ্রেত। আমরা আশাহত। মাননীয়া জানিয়েছেন, ওঁর কিছু কাজ রয়েছে। সেই কাজ হয়তো আমাদের এই অনশনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। তাই সোমবারের আগে আমরা সময় পেলাম না। তবু মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ফোনে বার্তালাপে বোঝা গেল, অনেক দাবিই ওঁর অজানা। আমাদের দাবিগুলি নিয়ে এখনও ওঁর স্পষ্ট ধারণা নেই। আমরা এখনও সোমবারের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। এই আশা নিয়েই বসে আছি যে, আমাদের অভিভাবক হিসাবে উনি নিশ্চয়ই আমাদের সমস্যার সমাধান করবেন।
সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা (অনশনকারী)
আমরা গত ১৪ দিন ধরে অনশনে বসে আছি। নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচার এবং ভবিষ্যতে আর কারও যেন এমন পরিণতি না হয়, এই আশাতেই অনশেন বসেছি আমরা। এর আগে আমরা প্রতিটি বৈঠকে আমাদের দাবিগুলি জানিয়েছি। পাশাপাশি, ইমেল করেও আমাদের ১০ দফা দাবি জানিয়েছি। এমনকি, এখানে অনশনে বসার আগেও সরকারকে ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। আবারও জানাচ্ছি, আমাদের সব সহকর্মী ইতিমধ্যেই কাজে ফিরেছেন। পরিষেবা চালু রয়েছে। শুধু আমরা আট জন কাজ করছি না, যারা অনশনে বসে আছি। আমরা বাধ্য হয়েছি এই সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ, আমরা এখনও ন্যায়বিচার পাইনি। এখনও আমাদের দাবি মানা হয়নি। যাঁরা আমাদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরাও বলেছেন, আমাদের প্রতিটি দাবি ন্যায্য। আমাদের আন্দোলনের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ। এখানে কোনও রাজনীতি নেই, কাউকে কালিমালিপ্ত করার অভিসন্ধি নেই। অভিভাবক হিসাবেই যখন উনি ফোনে কথা বলতে চাইলেন, তখনও আমরা দেখলাম, উনি যেন কোথাও গিয়ে ধৈর্য হারাচ্ছেন। হয়তো এই ১০ দফা দাবি এখনও ওঁর কাছে স্পষ্ট নয়। অনেক দাবিই এখনও ওঁর অজানা। এ জন্য কে বা কারা দায়ী? এ নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েই গেল। আমরা আগেও মুখোমুখি বসতে চেয়েছি, বসেছি। আবারও বসব। আজ এখনই বসতে চাইলে এখনই যেতাম। তবে উনি মুখ্যমন্ত্রী, ওঁর অন্য জরুরি কাজ থাকতেই পারে। চাইলে আরও কয়েক দিন অভুক্ত থাকব। এত দিন অনশন চলছে, আরও দু’তিন দিন অভুক্ত থাকতে অসুবিধা নেই। তবে আমরা এখনও আশাবাদী। ওঁর অভিভাবকত্বের উপর আস্থা রয়েছে। এই আশা নিয়েই আমরা সোমবার যাব।
রুমেলিকা কুমার (অনশনকারী)
আজ রাত সাড়ে ৮টা পেরোলে আমাদের তিন জন অনশনকারীর অনশনের পঞ্চদশ দিন পূর্ণ হবে। আমরা বাকিরাও অনশনরত। উত্তরবঙ্গেও আমাদের এখ সহযোদ্ধা অনশনে বসে রয়েছেন। আজ মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিব আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁরা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও আমাদের কথা বলিয়ে দেন। আমরা আজও তাঁর কাছে অনুরোধ জানাই, আমাদের ১০ দফা দাবি মেনে নিতে। আমাদের কিছু সুস্পষ্ট দাবি ছিল, যা নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার প্রশ্নটিকে সুনিশ্চিত করে। এত দিন যে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ চলছিল, যার ফলশ্রুতি হিসাবেই তৈরি হয়েছিল এই ভয়ের বাতাবরণ— যার মাশুল গুনতে হয়েছিল আরজি করের নির্যাতিতাকে, সেই অগণতান্ত্রিক পরিবেশ দূর করতেও আমাদের কিছু স্পষ্ট দাবি ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমরা দেখলাম, আমাদের দাবিগুলি উনি ঠিক করে জানেনই না! আমাদের প্রশ্ন, আমরা তো একই দাবি নিয়ে প্রথম দিন থেকে সোচ্চার হয়েছি! বারবার একাধিক প্রশাসনিক আধিকারিকের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। তাঁদের ইমেল মারফত লিখিত ভাবেও দাবিগুলি জানিয়েছি। তার পরেও আজ ৭১ দিন পরে মুখ্যমন্ত্রী দাবিগুলি জানেন না! তা হলে কি তাঁকে জানানো হচ্ছে না? এত দিন ধরে যে আন্দোলন চলছে, এতগুলো মানুষের প্রতিবাদের আওয়াজ, আমাদের এত জনের ভুখা পেটে কাতর আর্তি— কোনও কিছুই কি তাঁর কান অবধি পৌঁছচ্ছে না? ওঁর কি মনে হচ্ছে এই অনশনের কোনও গুরুত্ব নেই? আমাদের যে জুনিয়র ও সিনিয়র ডাক্তার ভাই-বোনেরা, স্বাস্থ্যকর্মীরা দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সচল রেখেছেন, তাঁদের প্রচেষ্টাকে কোথাও গিয়ে ওঁরা লঘু করে দেখছেন। উনি আজও যে ভাবে কাজে ফেরার অনুরোধ করলেন, তা বেদনাদায়ক। আমরা তো ঘোষিত ভাবে কর্মবিরতি তুলে নিয়েছি! সর্বত্র চিকিৎসা চলছে। জরুরি পরিষেবার পাশাপাশি সব রকম পরিষেবাই চলছে। অথচ আমাদের বারংবার বলা হচ্ছে কাজে ফিরতে! আমার মনে হয়, ওঁরা হয় জানেন না সরকারি হাসপাতালগুলি চলছে, বা ওঁদের কাছে আমাদের এই অনশনের কোনও গুরুত্বই নেই। আজ শনিবার। আর উনি সোমবার বৈঠক ডেকেছেন। অর্থাৎ, আরও দু’দিন বাধ্য হয়েই চালিয়ে যেতে হবে অনশন। উনি বললেন, আমরা ওঁর ছেলেমেয়ের মতো! অথচ ওঁর কি এক বারও মনে হল না এরা আরও দু’দিন না খেয়ে থাকবে? আমরা মেনে নিয়েছি। আমরা দু’দিন না খেয়েই থাকব। শুধু দু’দিন কেন, যত দিন পর্যন্ত আমাদের দাবিগুলি না মানা হচ্ছে, তত দিন পর্যন্তও না খেয়ে থাকতে পারব আমরা। আমাদের চোখ থাকবে সোমবারের বৈঠকের দিকে। দাবি না মানা হলে আন্দোলন একই তীব্রতায় চালু থাকবে।
আশফাকুল্লা নাইয়া (আন্দোলনকারী)
উনি সোমবার সময় দিয়েছেন মানে আরও দু’দিন অনশন চলবে। মনে রাখবেন, অনশনকারীরা শুধু একটা ‘ফোন কল’-এর জন্য জীবন বাজি রাখেনি। তারা শুধু একটা প্রতিশ্রুতির জন্য জীবন বাজি রাখেনি। আমাদের চোখ থাকবে সোমবারের বৈঠকের দিকে।
দেবাশিস হালদার (আন্দোলনকারী)
যে ভাবে ফোনে কথা হল, তা খুবই অসংবেদনশীল। ওঁরা অনশন তোলানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু যাঁরা অনশনে বসেছেন, এটা তাঁদের সকলের সিদ্ধান্ত। ফলে আলোচনা করেই আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। আমরা ভেবেছিলাম আজ সব মিটতে চলেছে। কিন্তু উনি বললেন, আজ ব্যস্ত। সোমবার বসবেন। আমরা সোমবারের অপেক্ষায় থাকব।