গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রায় দু’ঘণ্টা বৈঠক। তার পরে তিন ঘণ্টা ধরে সেই বৈঠকের কার্যবিবরণী (মিনিট্স) লেখা। সোমবার পাঁচ ঘণ্টা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে ছিলেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা। সেই বৈঠকের শেষে দু’পক্ষের স্বাক্ষরিত কার্যবিবরণী জনসমক্ষে এসেছে। কিন্তু আসেনি অনেক কিছু। আলোচনায় কী কী প্রসঙ্গ উঠেছিল? কালীঘাট বৈঠকের অন্দরের পরিবেশ কেমন ছিল? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
শনিবারের বৈঠক ভেস্তে গেলেও মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের চা খেয়ে যেতে বলেছিলেন। সেটা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। সোমবার বৈঠক শুরুর আগে এবং বৈঠক চলাকালীনও কয়েক বার জুনিয়র ডাক্তারদের চা পান করতে বলা হয়। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারেরা সবিনয়ে জানিয়ে দেন, তাঁরা চা পান করবেন না।
লাইভ স্ট্রিমিং, দু’পক্ষের ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ের টানাপড়েনের শেষে সোমবার কালীঘাটে বৈঠক হলেও আগে দু’বার বৈঠক ভেস্তে গিয়েছিল। সোম-বৈঠকের আগে জুনিয়র ডাক্তারদের শর্ত ছিল, দু’পক্ষই কার্যবিবরণী লিখবে। তাই দু’জন পেশাদার ‘স্টেনোগ্রাফার’ নিয়ে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁরাও ছিলেন বৈঠকে।
মোট ন’টি বিষয় কার্যবিবরণী তথা মিনিট্সে লেখা রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম আটটিই রাজ্য সরকারের খসড়া করা। নবম বিষয়টি জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে খসড়া করা। ওই নবম বিষয়টি নিয়েই সরকার পক্ষের সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ যুক্তি-পাল্টা যুক্তি চলেছে বৈঠকে। যেখানে শুরুতেই লেখা রয়েছে, ‘পশ্চিমবঙ্গ জুনিয়র ডাক্তার ফ্রন্টের প্রতিনিধিরা ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না করা এবং স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে অপসারিত না করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছে।’
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বৈঠকের পরে বলেন, ‘‘সকলকে সরিয়ে দিলে তো স্বাস্থ্য দফতরটাই ফাঁকা হয়ে যাবে!’’ অর্থাৎ, নিগমকে এখন সরানো হবে না। তবে ইন্দিরাকে নিয়ে তিনি বৈঠকের পরে কিছু বলেননি।
ইন্দিরার যে ভূমিকা নিয়ে আন্দোলনকারীর সরব হয়েছিলেন, তার মূল বিষয় ছিল সাংবাদিক সম্মেলনে ওই আইপিএস অফিসারের ভূমিকা। কেন তাঁকে লালবাজার ‘শিখণ্ডী’ করে ওই সব বলিয়েছিল, তিনিই বা কেন বলেছিলেন, সেই প্রশ্ন তোলেন জুনিয়র ডাক্তারদের কেউ কেউ। একাধিক বিষয়ে ইন্দিরার বয়ানকে ‘অসত্য’ বলে দাবি করেছিলেন নির্যাতিতার বাবা-মা। সেই প্রসঙ্গও তোলেন অনেকে।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের অপসারণ-সহ ডিসি (নর্থ) অভিষেক গুপ্ত এবং ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা যখন ডাক্তারদের তরফে বলা হচ্ছিল, তখন ডিজি রাজীব রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ-সহ সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিষয়ে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। ডাক্তারদের তরফে রাজ্য পুলিশের ডিজির উদ্দেশে সবিনয়ে বলা হয়, বৈঠকে তখন আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কিছু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। তাই তিনি যেন তাঁর মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। অনেকের মতে, রাজীবকে বলার সময় চিকিৎসকদের সুর একটু ‘চড়া’ ছিল। তবে সেটি অসমর্থিত সূত্রের খবর। প্রশাসনিক সূত্রেও বলা হয়েছে, কোনও পক্ষই সুর চড়ায়নি।
বৈঠক চলাকালীন অন্তত দু’বার আসন ছেড়ে উঠেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল এবং স্বাস্থ্যসচিব পদ থেকে নিগমের অপসারণের বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠক ছেড়ে উঠে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
বৈঠকে ফিরে মমতা জানান, স্বাস্থ্যের ডিএমই এবং ডিএইচএসকে তিনি বদল করতে পারেন। কিন্তু স্বাস্থ্যসচিবকে অপসারণের করার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ‘অপারগতা’ রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ব্যাখ্যা দেন, স্বাস্থ্যের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে হঠাৎ করে সকলকে বদলে দেওয়া হলে কাজে তার প্রভাব পড়বে। ইন্দিরা প্রসঙ্গে মমতা জানান, ঘটনাস্থল আরজি কর হাসপাতাল ইন্দিরার অধীনে নয়। তাই তাঁকে তিনি সরাচ্ছেন না। জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল, ডিসি (নর্থ) অভিষেক গুপ্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করুক রাজ্য সরকার। তাঁকে পদ থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার অভিষেকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আইপিএস দীপক সরকার।
জুনিয়র ডাক্তারদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে প্রথম দাবি ছিল আরজি করের নির্যাতিতার বিচার। যা এখন সিবিআইয়ের হাতে। জুনিয়র ডাক্তারেরাও তাতে একমত। ফলে আলোচনা এবং দর কষাকষির জন্য ছিল চারটি দাবি। তার অন্যতম দাবি ছিল কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে বিনীতের অপসারণ। কার্যবিবরণীর দ্বিতীয় বিষয়েই লেখা হয়, বিনীতকে সরানো হবে। রাতে তা ঘোষণাও করেন মমতা। মঙ্গলবার বিনীতকে পাঠানো হয় এডিজি (এসটিএফ) পদে। নতুন সিপি করা হয়েছে মনোজ বর্মাকে। প্রসঙ্গত, কয়েক দিন আগেও মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, পুজোর মুখে সিপি বদল করা সম্ভব নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে নেন।
জুনিয়র ডাক্তারদের পাঁচ দফা দাবির একটি ছিল স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে হুমকি সংস্কৃতি (থ্রেট কালচার) নির্মূল করা। বিভিন্ন ঘটনার কথা শুনে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি এতটা জানতাম না। জানলে এমন হতে দিতাম না।’’
সোমবারের বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে ৪২ জন হাজির ছিলেন। রাজ্যের তরফে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে হাজির ছিলেন মোট ৪২ জন। বৈঠক শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তাঁর বলার পর জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁদের দাবিগুলি উত্থাপন করেন। কেন তাঁরা সেই দাবি তুলছেন, সে ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাও দেন। তার পরে কথার পিঠে কথা এগোয়। কখনও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে জুনিয়র ডাক্তারেরা বলেছেন। কিন্তু কখনও আলোচনা ‘উত্তপ্ত’ হয়ে ওঠেনি। বৈঠকে উপস্থিত জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকেরই বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী ধৈর্য ধরে তাঁদের কথা শুনেছেন এবং নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন। এক জুনিয়র ডাক্তারের কথায়, ‘‘আমরা ওঁকে যে ভাবে দেখি, মনে হয় এ দিক-ও দিক হলেই বকুনি দেবেন, তেমন কিছুই হয়নি সোমবারের বৈঠকে।’’ সংখ্যায় বেশি হওয়ায় কখনও কখনও জুনিয়র ডাক্তারেরা একসঙ্গে চার-জন পাঁচ জন মিলে বলতে থাকেন। অনেক বার তেমন পরিস্থিতি হলেও এক বারই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘তোমাদের সব কথা আমি শুনব। কিন্তু তোমরা এক এক করে বলো।’’ সেই কথাও মমতা ‘নিচু এবং শান্ত’ স্বরেই বলেছেন বলে বৈঠকে উপস্থিত অনেকের বক্তব্য।