কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির বৈঠকও ভেস্তে গেল। —নিজস্ব ছবি।
কাটল না জট। শনিবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে গিয়ে তাঁদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানানোর পর থেকেই আশার আলো তৈরি হয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, শনিবারই হয়তো জট কেটে যাবে। বেরিয়ে আসবে কোনও রফাসূত্র। মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আন্দোলনকারীরা তাঁর সময় চান। মুখ্যসচিবের মেল পেয়ে এর পর কালীঘাটে তাঁর বাসভবনে পৌঁছয় জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল। কিন্তু তিন ঘণ্টা টানাপড়েনের পর ভেস্তে গেল মুখ্যমন্ত্রী-জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠক। নবান্নের পর কালীঘাটেও ‘লাইভ স্ট্রিমিং’-এর বিষয়টিই অন্তরাল হয়ে দাঁড়াল।
গত বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে নবান্নে বৈঠক করতে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। নবান্ন সভাঘরে বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মমতা। কিন্তু আন্দোলনকারীরা ওই বৈঠক সরাসরি সম্প্রচারের দাবিতে অনড় ছিলেন। প্রশাসন সেই দাবি মানতে নারাজ। প্রায় দু’ঘণ্টা দু’পক্ষের মধ্যে কথা হওয়ার পরেও বৈঠক হয়নি। নবান্ন থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল জুনিয়র ডাক্তারদের। শনিবারও কালীঘাটের বৈঠক ভেস্তে গেল সেই ‘লাইভ স্ট্রিমিং’-এর কারণেই। বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার করার দাবিতে অনড় ছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তবে প্রশাসন সেই দাবি মানেনি। এই নিয়ে আলোচনা চলে দু’পক্ষের মধ্যেই। এমনকি, মুখ্যমন্ত্রী নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বৈঠকে বসার আহ্বান জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বৈঠক হল না শনিবারও।
আরজি কর-কাণ্ডে উত্তাল গোটা রাজ্য। বিচারের দাবিতে পথে জুনিয়র ডাক্তারেরা। গত মঙ্গলবার পাঁচ দফা দাবি নিয়ে স্বাস্থ্য ভবন অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন তাঁরা। করুণাময়ী থেকে মিছিল করে স্বাস্থ্য ভবনে পৌঁছন জুনিয়র ডাক্তারেরা। কিন্তু স্বাস্থ্য ভবনের সামনেই সেই মিছিল আটকে দেওয়া হয়। পুলিশি ব্যারিকেডের সামনেই বসে পড়েন আন্দোলনকারীরা। সেই থেকে টানা অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। শনিবার সেই অবস্থান পাঁচ দিনে পড়েছে। গত কয়েক দিনে জট কাটানো নিয়ে দড়ি টানাটানি চলেছে। ইমেল-পাল্টা ইমেল চলছে প্রশাসন এবং জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে।
জুনিয়র ডাক্তারদের ‘রাত দখলের’ ডাক
শনিবার সকালেই আবারও ‘রাত দখলের’ ডাক দেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা। গত ১৪ অগস্ট, ঠিক এক মাস আগে আরজি করে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার প্রতিবাদে ‘রাত দখলের’ সাক্ষী ছিল কলকাতা-সহ গোটা রাজ্য। ‘মেয়েদের রাত দখলে’ পা মিলিয়েছেন পুরুষেরাও। সকলের গলাতেই ছিল একটাই স্বর, ‘বিচার চাই’। সে দিন রাতে ভিড়ের মধ্যে আরজি কর হাসপাতালে হামলার ঘটনা ঘটে। একদল দুষ্কৃতী হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসকদের ধর্নামঞ্চ ভেঙে দেয় বলে অভিযোগ। ভাঙচুর চালানো হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। এক মাস পর আবার রাত দখলের ডাক দেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে মমতা
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য নবান্ন পর্যন্ত গেলেও, শেষ পর্যন্ত বৈঠক ভেস্তে গিয়েছিল। তার পর আবার স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ফিরে যান আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি দল। শুক্রবার বৃষ্টি উপেক্ষা করেই তাঁরা রাত কাটিয়েছেন স্বাস্থ্য ভবনের সামনের রাস্তায়। নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে অনড় ছিলেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা। শনিবার সকালেও ধর্নামঞ্চ থেকে ‘বিচারের দাবিতে’ মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে। আচমকা দুপুর ১টা নাগাদ জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী।
‘মুখ্যমন্ত্রী নয়, আপনাদের দিদি হিসাবে এসেছি’
রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারকে সঙ্গে নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে শনিবার দুপুরে পৌঁছেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের আন্দোলনকে কুর্নিশ জানাচ্ছি। আমি আপনাদের ব্যথা বুঝি। শুক্রবার সারা রাত ঝড়জল হয়েছে। আপনারা যে ভাবে বসে আছেন, আমার কষ্ট হচ্ছে। গত ৩৪ দিন ধরে আমিও রাতের পর রাত ঘুমোইনি। কারণ, আপনারা রাস্তায় থাকলে আমাকেও পাহারাদার হিসাবে জেগে থাকতে হয়।’’
ধর্নামঞ্চে গিয়ে মমতা জানান, তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নয়, তাঁদের দিদি হিসাবে এসেছেন। ধর্নামঞ্চ থেকেই আশ্বাস দেন, রাজ্য সরকার ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করবে না। তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা চলছে। কোনও পদক্ষেপ আপনাদের বিরুদ্ধে করা হবে না। এখন আমি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এখানে আসিনি। আন্দোলনের সমব্যথী হিসাবে এসেছি। আপনাদের বড় দিদি হয়ে এসেছি। আমাকে সময় দিন। ভাল থাকুন।’’ আলোচনার পথ খোলা রেখে ধর্নামঞ্চ ছাড়েন মমতা।
আলোচনায় বসতে রাজি, জানান আন্দোলনকারীরা
মুখ্যমন্ত্রী ধর্নামঞ্চ ছাড়লেই আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট জানান, তাঁরা আলোচনা করতে রাজি। তাঁরা মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের পথ বার হবে। তবে তাঁদের পাঁচ দফা দাবি থেকে সরতে নারাজ জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘স্থান, সময় জানালেই আমরা আলোচনার জন্য পৌঁছে যাব। পাঁচ দফা নিয়ে আমরা কোনও রকম সমঝোতায় যেতে চাই না। দাবি নিয়ে অতি দ্রুত আলোচনায় বসতে চাই। আমরা বলেছি, পাঁচ দফা দাবি নিয়ে যে কোনও সময়ে আলোচনায় বসতে পারি। মুখ্যমন্ত্রী এখানে এসেছেন, সাধুবাদ জানাচ্ছি। এখনই আলোচনার মাধ্যমে অচলাবস্থা কাটানোর দাবি জানাচ্ছি। আমাদের দাবি মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিন।’’
মুখ্যমন্ত্রীকে ইমেল জুনিয়র ডাক্তারদের
মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ধর্নামঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করতে জুনিয়র ডাক্তারেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনাতেও বসেছিলেন। সেই বৈঠক থেকেই নবান্নে ইমেল করে আন্দোলনকারীরা জানান, তাঁরা বৈঠকে বসতে রাজি। সময়, তারিখ এবং স্থান জানানোর আবেদন করা হয়েছিল সেই ইমেলে। শুধু তাই-ই নয়, দ্রুত ‘স্বচ্ছ’ আলোচনার কথাও জানান ডাক্তারেরা। বিকেল ৪টে ১০ মিনিট নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীকে ইমেল করেন তাঁরা।
এক ঘণ্টার মধ্যে ইমেলের উত্তর ডাক্তারদের
বিকেল ৫টার মধ্যেই উত্তর এসে যায় জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে। আলোচনা চেয়ে তাঁরা যে ইমেল পাঠিয়েছিলেন, সেই ইমেলে সাড়া দিয়ে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ জানান, মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে সন্ধ্যা ৬টায় জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। ১৫ জনের প্রতিনিধি দল উপস্থিত থাকতে পারবেন সেই বৈঠকে।
১৫ নয় ৩০
মুখ্যসচিব ১৫ জনের প্রতিনিধি দলের কথা বললেও ৩০ জনের দাবিতে অনড় থাকেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। মুখ্যসচিবের ইমেল পাওয়ার পরেই কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয় জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে। নিজেদের মধ্যে বৈঠক করার পর তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের দাবি ন্যায্য। সে জন্য তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) এসেছিলেন। যে কোনও জায়গায় আমরা আলোচনায় প্রস্তুত। ভেবেছিলাম প্রশাসনিক জায়গায় ডাক আসবে, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কালীঘাটে ডাক এল। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে। তিনি হয়তো ভাবছেন, আমরা যাব না। কিন্তু আমরা যাব। সদিচ্ছা রয়েছে বলেই যাব।’’ শেষে তাঁরা জানান, ৩০ জনের প্রতিনিধি দল নিয়েই বৈঠকে বসতে চান।
কালীঘাটে ৩২ জনের প্রতিনিধি দল
১৫ জনের কথা বলা হলেও জুনিয়র ডাক্তারদের ৩২ জনের প্রতিনিধি দলকেই কালীঘাটের বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বৈঠক ভেস্তে যায়। একে একে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ছাড়েন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল আবারও ফিরে যায় সল্টলেকের ধর্নামঞ্চে।
কেন ভেস্তে গেল বৈঠক?
কালীঘাটের বাড়িতে জুনিয়র ডাক্তারদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর বাড়ির বাইরে ছিলেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের দাবি ছিল, বৈঠক সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। এই দাবিতে তাঁরা যখন অনড়, তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলেন জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে। জুনিয়র ডাক্তারদের ভিতরে যেতে অনুরোধ করেন তিনি। মমতা বললেন, ‘‘বৈঠক না করো অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যাও। ভিজো না। তোমাদের অসুখ করলে আমার খারাপ লাগবে। আমরাও কেউ ভিডিয়ো রেকর্ডিং করব না।’’ মমতা জানালেন, আন্দোলনকারীরা যে চিঠি দিয়েছিল, তাতে সরাসরি সম্প্রচারের কথা ছিল না। জুনিয়র ডাক্তারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘যদি না-ই আসো তা হলে চিঠি দিলে কেন? মানুষের স্বার্থে এসো, কথা বলো। মিনিটস সই করে দেব, আমাদের তরফে এক জন সই করবে, তোমাদের তরফেও এক জন সই করবে। তোমরা যদি কথা বলতে না চাও, বৈঠক না করো, অন্তত এক বার ভিতরে এসে চা খেয়ে যাও।’’ কিন্তু আন্দোলনকারীদের দাবি, প্রশাসনের ‘শর্ত’ মেনে তাঁরা যখন আলোচনায় বসতে চান, তখন তাঁদের জানানো হয়, ‘অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি, তাঁদেরও ‘সদিচ্ছা’ রয়েছে। কথা বলতে চান তাঁরা। আরও আধ ঘণ্টা সময় চান তাঁরা। জানান, ঘড়ি, মোবাইল জমা রেখেই ভিতরে প্রবেশ করবেন। তবে মুখ্যসচিব জানান, আর সম্ভব নয়। প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন তাঁরা। চন্দ্রিমা বলেন, ‘‘আমরাও কথা বলতে চেয়েছি।’’ শেষমেশ কোনও আলোচনা হল না শনিবারও।