কুষ্ঠ নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ির ভয় এখনও কাটেনি। বিস্তর প্রচারের পরেও এইচআইভি সংক্রমণ নিয়ে অজস্র ভুল ধারণা থেকে গিয়েছে। এরই পাশাপাশি ইদানিং বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, ক্যানসার নিয়েও সাধারণ মানুষের মনে নানা ভ্রান্ত ধারণা, সংস্কার, আতঙ্ক প্রায় বদ্ধমূল। প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, খাস কলকাতাতেও একই ছবি। বাগুইআটির জ্যাংরায় পুত্রের ক্যানসার হওয়ার খবর জেনে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা-মার আত্মহত্যার খবর সেই ভুল ধারণার ছবিকেই আরও একবার সামনে এনেছে।
পুলিশের অনুমান, ছেলের ক্যানসার হয়েছে জানার পরেই বাবা-মা ধরে নিয়েছিলেন সে আর বেশি দিন বাঁচবে না। পুত্রশোক সহ্য করার আগে তাই একই সঙ্গে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। কোন ধরনের ক্যানসার, তার চিকিৎসা কী, সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা সে সব বোঝার চেষ্টাই করেনি ওই শিক্ষিত পরিবার। চিকিৎসকেরা মনে করছেন, ক্যানসার মানেই সাক্ষাৎ মৃত্যু, এই ভুল ধারণা এখনও কাটেনি। এরই পাশাপাশি এই রোগকে ঘিরে থেকে গিয়েছে আরও অজস্র সংস্কার।
সে গুলো কীরকম? কলকাতার এক ক্যানসার চিকিৎসক শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। স্ত্রী-র জরায়ু ক্যানসার হয়েছে বলে আলাদা ঘরে শোয়া শুরু করেন তাঁর পঞ্চাশোর্ধ্ব স্বামী। অথচ এক সময়ে তাঁরাই ‘আদর্শ দম্পতি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে। ডাক্তারের কাছে সে কথা কবুল করে তিনি বলেছেন, ‘‘রোগটার কথা জানার পর থেকে ভিতরে ভিতরে কেমন যেন লাগছে। আমি তো সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালন করছি, কিন্তু ওর সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। বলা তো যায় না, যদি আমারও কিছু হয়ে যায়।’’ শিক্ষিত, নামী সংস্থার বড় চাকুরে স্বামীকে ডাক্তাররা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন যে ক্যানসার ছোঁয়াচে নয়।
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছেও এমন অভিজ্ঞতা অজস্র। তাঁর কথায়, ‘‘অস্ত্রোপচারের পর স্তন ক্যানসার থেকে সেরে উঠেছেন
এক মহিলা। কিন্তু তার পরেও পারিবারিক
কোনও শুভ কাজে তাঁকে অংশ নিতে দেওয়া হয় না। তিনি কোনও শিশুকে কোলে নিতে গেলে শিশুটির মা শিউরে
উঠে সন্তানকে সরিয়ে নেন। ২০১৫-তেও এই ঘটনা ঘটছে। আমরা হয়তো বিচ্ছিন্ন ভাবে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই চেষ্টা সামগ্রিক পরিস্থিতির কাছে নেহাৎই সামান্য।’’
সত্যিই যে কতটা ‘সামান্য’ তার প্রমাণ মেলে চারপাশের নানা ঘটনায়। এক যৌথ পরিবার। সেখানে ঠাকুমার অন্যতম আনন্দের উৎস ছিল সকালবেলা নাতনির সঙ্গে বসে একই কাপ থেকে চা খাওয়া। নাতনিকে তাঁর ঠাকুমার এমন প্রশ্রয়ের মধুর মুহূর্তটুকু পরিবারের সকলের কাছেই খুব প্রিয় ছিল। বাদ সাধল ঠাকুমার ক্যানসার। রোগ ধরা পড়ার পরে ছেলে এবং বৌমা জানিয়ে দিলেন, একই কাপ থেকে চা খাওয়া আর চলবে না।
কিছু দিন আগের কথা। লিউকেমিয়ার শিকার এক শিশুর পরিবারকে কার্যত এক ঘরে করে দেওয়া হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে। এমনকী ক্যানসার হওয়ার অপরাধে ওই পরিবারকে গ্রামছাড়াও হতে হয়েছিল এক সময়।
ক্যানসার চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘খরচের ভয়েও অনেকে আত্মহত্যার কথা ভাবেন। কিন্তু ইদানিং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তহবিল থেকে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিমা থেকেই পাওয়া যায়।’’ আবার ক্যানসার চিকিৎসক সৈকত গুপ্ত বলছেন, ‘‘বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসার আগেই ধরে নেন, তাঁর জীবনে কয়েকটা দিন বাকি। মাঝেমধ্যে এ-ও শুনতে হয়, অস্ত্রোপচার করালে ক্যানসার আরও ছড়িয়ে যাবে, তাই কাটাছেঁড়া করে কী লাভ? এই সব ভুল ধারণা না কাটলে যত আধুনিক চিকিৎসাই বেরোক না কেন, তার সম্পূর্ণ উপকার রোগীরা পাবেন না।’’
তা হলে উপায়? ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আমরা যে সকলকে বুঝিয়ে উঠতে পারছি না, সেই ব্যর্থতার দায় অনেকটাই আমাদের।’’ কিন্তু শুধু ডাক্তারদের পক্ষে কি এই দায়িত্ব পালন সম্ভব? তাঁর জবাব, ‘‘সরকারি-বেসরকারি যৌথ চেষ্টা দরকার।’’
যদিও সরকারি তরফে এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। রাজ্যের হাতে গোণা কয়েকটি হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেই দায় সেরেছে স্বাস্থ্য দফতর। ক্যানসার যে ছোঁয়াচে নয়, যথাযথ চিকিৎসায় যে বহু ক্ষেত্রেই সেরে যায়, সে কথা প্রচার করার কোনও চেষ্টাই হয় না। দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘এই দায়িত্বটা বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির নেওয়ার কথা।’’
ক্যানসার নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে অমিত সরকার বলেন, ‘‘কাজটা এক দিনে হওয়ার নয়। বহু বছর ধরে এই কাজই করছি। পরিস্থিতি হয়তো আগের তুলনায় কিছুটা বদলেছে। কিন্তু এখনও বহু পথ চলা বাকি।’’