মন্দিরে চৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দ।
প্রায় ৫০০ বছর আগে পানিহাটির ঘাটে আসেন শ্রীচৈতন্যদেব। এখানে দণ্ডদান করেন নিত্যনন্দ মহাপ্রভু। সেই উপলক্ষে ফি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে পালিত হয় ‘দণ্ড উত্সব’। পানিহাটি মহোত্সবতলায় শ্রীচৈতন্যদেব আর নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর পায়ের ছাপ রাখা আছে। কিন্তু আগ্রহী ও পর্যটকদের কাছে ঐতিহ্যের এই অঞ্চল আকর্ষণীয় করে তোলার ব্যাপারে উৎসাহী নয় পর্যটন দফতর কিংবা পুরসভা। এ বার সেখানে পরিকল্পনা করেছে ‘ইস্কন’।
কথিত রয়েছে, পানিহাটির এই ঘাটে শ্রীচৈতন্যদেব এসেছিলেন ৯২১ বঙ্গাব্দে, ১৫১৪-র কৃষ্ণা দ্বাদশীতে। এর পর ফের ১৫১৫-র ফাল্গুনে, কৃষ্ণা একাদশীতে। তাঁর এই আবির্ভাবের জেরে ধর্মস্থান হিসাবে অচিরেই নাম করে মহোত্সবতলা। ১৫১৬ থেকে প্রতি বছর শুক্লা ত্রয়োদশীতে এখানে বসে ‘দণ্ড উত্সব’। কয়েক বার এখানে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শেষ বার আসেন মৃত্যুর আগের বছর ১৮৮৫-তে। এসেছিলেন গিরিশ ঘোষ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ থেকে স্বামী সারদানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ থেকে লাটু মহারাজ, ‘কথামৃত’র রচয়িতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীম)। ১৯৩৯-এ আসেন মহাত্মা গাঁধী।
বিটি রোড থেকে অপরিসর, আঁকাবাঁকা রাস্তার হাল খুবই খারাপ। মহোত্সব ঘাটের পাশে স্তূপীকৃত জঞ্জাল। লোহার প্রাচীরের একাংশ ভেঙে গিয়েছে। প্রতি বছরের মতো এ বারেও ক’দিন আগে এখানে মেলা বসে ছিল। আসেন কয়েক হাজার পুণ্যার্থী। বেহাল রাস্তায় ভুগতে হয়েছে ওঁদের। খুব খারাপ অবস্থা স্থানীয় দুই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা রাজা রামচাঁদ রায় রোড এবং ডি এন ব্যানার্জি রোডের। অল্প বৃষ্টি হলে জলেকাদায় একাকার!
কেন এমন হাল? পুরসভার চেয়ারম্যান স্বপন ঘোষ বলেন, ‘‘ওই তল্লাটে পানীয় জলের নতুন সংযোগ বসেছে। বি টি রোড থেকে ঘাট পর্যন্ত প্রায় পৌনে দু কিলোমিটার রাস্তা পর্যায়ক্রমে মেরামত হচ্ছে।’’ ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার পিনাকী মজুমদার বলেন, ‘‘রাস্তা মেরামতির কাজ মূলত করছে কেএমডিএ। সমস্যা হচ্ছে পুরনো অপরিকল্পিত অঞ্চল বলে কিছু অংশে প্রস্ত ২০ ফুটও পাওয়া যাচ্ছে না।’’
আশপাশে একগুচ্ছ মন্দির। ঘাটে বিস্তীর্ণ গঙ্গাতীরে দু’টি প্রাচীন বটগাছে বাঁধানো বেদি, রাধাকৃষ্ণের মন্দির। আছে একটি দ্বিতল সরকারি ভবন। সামনের ফলকে লেখা, ২০০৪-এ এটির উদ্বোধন করেন তত্কালীন মন্ত্রী অঞ্জু কর। এখন অবশ্য বাড়িটি সদ্য নীল-সাদায় রাঙানো। ঠিক বিপরীতে ‘অমৃততীর্থ’। এই বাড়িতেও তীর্থস্থান। তার ফলকে লেখা এখানে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। একটু এগিয়ে ৩৭, গৌরাঙ্গঘাট রোডে শতাধিক বছরের প্রাচীন বাড়ি ও দেবস্থান কিনে নিয়েছে ‘ইস্কন’। পুরনো বাড়ির উপর তলায় তৈরি হয়েছে মন্দির। পাশে জগদ্ধাত্রী মন্দির ও গঙ্গাতীরে দু’টি শিবমন্দির। দেওয়াল ও ঘাটের ছাদের একাংশ ভেঙেছে। পুরো জায়গা এবং লাগোয়া জমির একাংশ নিয়ে কয়েক কোটি টাকার পরিকল্পনা করেছে ইস্কন।
৩ বিঘা ১০ কাঠা জমির উপর গঙ্গাতীরের এই বাড়িটি বানিয়েছিলেন বন্দুক ব্যবসায়ী দাঁ-পরিবার। মূল বাড়ি ১ বিঘা ৫ কাঠার উপর। ইস্কন-এর পানিহাটি শাখার সমিতি সদস্য রঘুনন্দন দাস এ কথা জানিয়ে বলেন, “এটি প্রথমে কেনেন আমাদের এক ভক্ত। তাঁর কাছ থেকে আমরা কিনে নিই। লাগোয়া জগদ্ধাত্রী মন্দির ছিল নন্দলাল দাঁ-র ঠাকুরবাড়ি। ৩ বিঘা ১০ কাঠা জমি নিয়েছি ৯৯ বছরের লিজে। পরিত্যক্ত এই বাড়ি সমাজবিরোধীদের ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল। ওদের হঠাতে আমাদের বেগ পেতে হয়েছে।” এই মন্দিরের অষ্টধাতুর মূর্তি চুরি হয়ে গিয়েছিল। এখন সাময়িক ভাবে পুজো হচ্ছে ছোট বিগ্রহের।
পানিহাটিতে ইস্কনের ছয় তলা ভবন হবে। অতিথিশালায় থাকবে মন্দির, ১০৮টি অতিথিঘর। পুরসভার প্রাথমিক ছাড়পত্র মিলেছে। জমির মালিকানা পানিহাটি উন্নয়ন ট্রাস্ট থেকে ইস্কনের নামে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্প চত্বরে সাজানো বাগান, গাড়ি রাখার জায়গা থাকবে। প্রতি সন্ধ্যায় হবে ‘গঙ্গাপুজো’। পাশে কাদাবর্জ্য মাখা ঘাট দেখিয়ে এক স্বেচ্ছাসেবী জানালেন, “ওটা পরিত্যক্ত ফেরিঘাট, সরকারি জায়গা। আমরা মহিলাদের স্নানঘাট বানিয়ে দেব।”
আগ্রহী পর্যটকদের নিয়ে পানিহাটি থেকে মায়াপুর পর্যন্ত জলভ্রমণের ব্যবস্থাও করছে ইস্কন। এ কারণে সাড়ে ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে আমদানি করেছে ১২ আসনের জলযান। এখানকার ঘাট ও পরিকাঠামো সাজিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে তা শুরু করার পরিকল্পনা। আপাতত পরীক্ষামূলক ভাবে চালানো হচ্ছে ডোমজুড়ে। রঘুনন্দন দাস বলেন, “বছর দুয়ের মধ্যে আমরা পুরো কাজ শেষ করার চেষ্টা করব। পানিহাটির আকর্ষণ ও গুরুত্ব বাড়বে বহুগুণ।”
মহোৎসবতলা ও সংলগ্ন অঞ্চলের আকর্ষণ বাড়াতে পর্যটন দফতরের কাছেও জমা পড়েছে স্থানীয় পুরসভার রিপোর্ট। পর্যটন দফতরের এক পদস্থ অফিসার জানান, ‘‘প্রায় সাত কোটি টাকা খরচ করে এলাকার সৌন্দর্যায়ন, মন্দির সংরক্ষণ এবং আলোর ব্যবস্থা করার প্রস্তাব রয়েছে তাতে। বিভাগীয় সচিব এ ব্যাপারে সমীক্ষার পরে চূড়ান্ত অনুমোদনের অনুরোধ করে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের কাছে তাঁর সমীক্ষার রিপোর্টটি পাঠিয়েছেন।’’