ফাইল ছবি
পেগাসাস-কাণ্ডে তদন্ত কমিশন গড়ে ফোনে আড়ি পাতার বিষয়ে আদৌ কোনও রহস্যভেদ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আইনজ্ঞরা। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গাপাধ্যায় থেকে শুরু করে প্রবীণ আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন, ওই বিষয়ে কমিশন গঠন করার এক্তিয়ারই নেই রাজ্য সরকারের। বস্তুত, কোনও রাজ্যেরই নেই। কারণ, বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে ঘটেছে। রাজ্যের এক প্রবীণ আইনজীবীর কথায়, ‘’কলকাতা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে কেউ আবেদন করলে এই কমিশন খারিজ হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।’’
পেগাসাস-কাণ্ডে বাংলার কয়েকজনের ফোনেও আড়ি পাতা হয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যমের দাবি। তাঁদের মধ্যে নাম রয়েছে তৃণমূলের অন্যতম নেতা তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের। নাম রয়েছে কলকাতার এক সাংবাদিকেরও। সেই সূত্রেই সুপ্রিম কোর্টের দুই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে ওই কমিশন গঠন করা হয়েছে। তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের দাবি, কমিশন গঠন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য মনে করছেন, এই কমিশন গঠন করার এক্তিয়ারই নেই রাজ্যের। সোমবার তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘রাজ্যের কোনও বিষয়ে রাজ্য সরকার কমিশন গঠন করতেই পারে। যেমন বানতলা-কাণ্ড বা একুশে জুলাইয়ের গুলিচালনা নিয়ে করা হয়েছিল। কিন্তু এটা তো তা নয়! দেশের দেশের সংবিধানের সপ্তম শিডিউলের লিস্ট ওয়ানের ৩১ নম্বর আইটেমে বলা আছে, ডাক-তার বিভাগ, টেলিফোন-সহ যাবতীয় যোগাযোগের মাধ্যম কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। কমিশন সেই অফিসারদের ডাকলে তাঁরা কেন আসবেন?’’ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের আরও বক্তব্য, ‘’প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকার এই কমিশনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনও করতে পারে। কিন্তু তারও প্রয়োজন হবে না। অফিসারেরাই আসবেন না কমিশনে সাক্ষ্য দিতে।’’
প্রবীণ আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের বক্তব্য, ‘’কীসের উপর ভিত্তি করে এই তদন্ত কমিশন করা হল? একটি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কি তদন্ত কমিশন হয়! কমিশন পেগাসাসকে ডাকলে তারা কি সাক্ষ্য দিতে আসবে? ইজরায়েল সরকার সাক্ষ্য দিতে আসবে? কমিশন যে কেউ ঘোষণা করতেই পারেন। কিন্তু তার কার্যকারিতা বা কার্যকারণ বলে তো কিছু একটা থাকবে!’’ অরুণাভর কথায়, ‘’সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছে, ৩০০ লোকের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। কিন্তু কেউ কি বলেছে, তারা আড়ি পাতিয়েছে? কেন্দ্রীয় সরকার কি বলেছে? তা হলে কাদের ডাকা হবে সাক্ষ্য দিতে?’’
ঘটনাচক্রে, তৃণমূলের অন্দরেও এই বিচারবিভাগীয় কমিশন নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। যদিও প্রকাশ্যে কেউই এ নিয়ে মন্তব্য করতে নারাজ। তবে তৃণমূলের হিতৈষী এক প্রবীণ আইনজ্ঞের বক্তব্য, ‘’এটা টেলি যোগাযোগের চেয়েও বেশি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের বিষয়। টেলি যোগাযোগ তার একটা অংশ হতে পারে। হয়তো এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ জড়িত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা ছাড়া এখানে কিছুই করা সম্ভব নয়। উপরন্তু এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র জড়িত। ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে এর সুরাহা করা বা এই রহস্যভেদ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।’’ ওই আইনজ্ঞের আরও বক্তব্য, ‘’যদি আদৌ আড়ি পাতার মতো অপরাধ হয়ে থাকে, তা সংঘটিত হয়েছে বিদেশে। তাতে যে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তদন্ত তো হবে অপরাধের। সেটা তো এ দেশে হয়নি। তৃণমূল-সহ বিরোধীরা কেন্দ্রীয় সরকারকে কাঠগড়ায় তুলছে বটে। কিন্তু সেটা তো শুধুমাত্র অভিযোগ!’’
আইনজ্ঞদের আরও দাবি, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নিয়ে রাজনীতির ধারনা তৈরি করা গেলেও আইনের চোখে তা গ্রাহ্য হয় না। ফলে সংবাদমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে তদন্ত কমিশন গঠন করলেও তাতে কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হয় না। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য তেমনকিছু ভাবছেন না। তাঁদের দাবি, মমতাই প্রথম পেগাসাস নিয়ে তদন্ত কমিশন গড়ে মোদী-শাহ জুড়িকে বার্তা দিয়েছেন। যার ফলে একদিকে যেমন কেন্দ্রের উপর চাপ বাড়ানো গিয়েছে, তেমনই নিজেকে মোদীর বিরোধী ‘মুখ’ হিসেবে কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।