২০০৫ এবং ২০০৭ সালে তনভির ইসলামের ছবির সঙ্গে কানাডার তারেক রানার সাম্প্রতিক ছবির সঙ্গে সাদৃশ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ছবি: সংগৃহীত।
দু’জনের মধ্যে কী ভীষণ মিল! নামে। ছবিতে। শরীরী চিহ্নে। পিতৃ পরিচয়ে। জন্মতারিখে। সব কিছুতে বড় আশ্চর্য রকমের মিল। কিন্তু, তারেক রানার দাবি তিনি কিছুতেই খোন্দকার তনভির ইসলাম ওরফে জয় নন! বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তনভীরের সঙ্গে তাঁর অ্যাত্ত মিল যে তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলছে, সে কথাও জানিয়েছিলেন রানা। কিন্তু কলকাতা থেকে গিয়ে ২০১৪ সাল থেকে তিনি যে দেশে থাকছিলেন, সেই কানাডা থেকেই রানা পালিয়ে গিয়েছেন। বর্তমানে ‘বেপাত্তা’! ফলে বাংলাদেশ-ভারত-কানাডার গোয়েন্দারা তো বটেই, খোদ ইন্টারপোলও নিশ্চিত, তাদের জারি করা ‘রেড কর্নার নোটিস’ যার বিরুদ্ধে, সেই খোন্দকার তনভির ইসলাম এবং কানাডার প্রতিশ্রুতিমান উদ্যোগপতি তারেক রানা আদতে একই ব্যক্তি।
কে এই খোন্দকার তনভির ইসলাম ওরফে জয়? কে-ই বা তারেক রানা?
বাংলাদেশের ‘দাউদ ইব্রাহিম’ হিসাবে ‘খ্যাত’ জয় সে দেশে কয়েক ডজন খুন, তোলাবাজি, অপহরণে মামলায় অভিযুক্ত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অনুরোধে ইন্টারপোল ‘রেড কর্নার নোটিস’ জারি করে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ পুলিশ জানাচ্ছে, সেই সময়েই তারা জয়ের মাথার দাম রেখেছিল ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশের কুখ্যাত সেভেন স্টার গ্যাংয়ের পাণ্ডা সে। ঢাকার ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা তোলা আদায় করে ‘সেভেন স্টার গ্যাং’। টাকা না দিলে খুনও করতে পিছপা হত না তারা।বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, ২০০৬-এর ১৪ মে বিদেশে কাজের জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া সংস্থা ‘তুর্কি অ্যাসোসিয়েট’-এর মালিককে ৮ লাখ মার্কিন ডলার চেয়ে ফোন করে জয়। টাকা না দেওয়ায় ওই সংস্থার অফিসে ঢুকে ৬ জনকে গুলি করে খুন করে জয়ের দলবল। জয় তখন সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে টাকা চেয়েছিল বলে বাংলাদেশ পুলিশের দাবি।
আরও পড়ুন: কমান্ডো পরিচয়ে এটিএম জালিয়াতি
এ রকম একের পর এক খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকা পুলিশের দাবি, এখনও শহরের বুকে জয়ের দলবল টাকা তোলে একই রকম ভাবে। বাংলাদেশি টাকায় ৫ কোটি পর্যন্ত তোলা চায় জয়ের গ্যাং! এক সময়ে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসাবেও পরিচয় দিত সে!
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কিন্তু, জয়কে সেই সময় কেউ ধরতে পারেনি।
এর পরের ঘটনা খাস কলকাতায়। সেটা ২০০৭ সাল। বাগুইআটির চিনার পার্কের একটি বাড়ি থেকে জয়কে গ্রেফতার করে এ রাজ্যের সিআইডি। দেখা যায় ভোল বদলে তারেক রানা নামে সে গা ঢাকা দিয়ে ছিল বাগুইআটির ওই ভাড়াবাড়িতে। ভুয়ো নথির মাধ্যমে তারেক রানা নামে সে তত দিনে ভারতীয় পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ড্রাইভিং লাইসেন্স— সবই জোগাড় করে ফেলেছে। এ দেশে তার পরিচয় তখন ‘জি ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক সংস্থার মালিক! সিআইডি তার বিরুদ্ধে পাঁচটি আলাদা আলাদা মামলা রুজু করে। সেই সময় সিআইডির ডিআইজি (অপারেশনস) ছিলেন সিআইডির বর্তমান এডি়জি রাজীব কুমার। তাঁর নেতৃত্বেই তৈরি হয় স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ। তারাই গ্রেফতার করে জয়কে। এই মামলাগুলো যখন চলছে, তখনই জয়কে ফেরত পেতে ভারতকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। সেই সময়ে স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আনন্দবাজারকে জানাচ্ছেন, ওই প্রত্যর্পণ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই জামিন পেয়ে যায় জয়। তার পর প্রায় কর্পূরের মতো উবে যায় সে কলকাতার বুক থেকে।
কলকাতায় গ্রেফতার হওয়ার পর তনভিরের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ভারতীয় পাসপোর্ট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পায় সিআইডি। ছবি: সংগৃহীত।
এর পর জয়ের আর কোনও ‘খোঁজ’ পাওয়া যায়নি।
কানাডার অভিবাসন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালে পর্যটক ভিসা নিয়ে সে দেশে তারেক রানা নামে এক ব্যক্তি যান। সেই তারেক রানাকেই ২০১৪ সালে কানাডার অভিবাসন দফতর ১০ বছরের ভিসা দেয়। তখন থেকেই তিনি সেখানে আছেন। ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে কানাডার টরোন্টোর শহরতলি আয়াক্সে ওই ‘ভারতীয়ের’ নাম এক জন সফল ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারেকের দাবি, তাঁর জন্ম থেকে বড় হওয়া— সবটাই কলকাতায়। আয়াক্সের অভিজাত এলাকায় তাঁর ‘এসজে ৭১’ সংস্থার বিশাল অফিস রয়েছে। নিয়মিত তাঁকে সেখানকার ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা যায়। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের অর্থসাহায্য করেন তিনি। এমনকি সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলেও দেন মোটা চাঁদা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে তারেককে এক জন উদ্যোগপতি হিসাবেও বর্ণনা করা হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়, তিনি সে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, এনেছেন বিনিয়োগও।
আয়াক্স শহরের মেয়র শন কোলিয়ার (বাঁ দিকে), কাউন্সিলর আসমিদ খান (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়) লিবারেল এমপি মার্ক হল্যান্ডের সঙ্গে তারেক রানা। ছবি মার্ক হল্যান্ডের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।
কলকাতার উদ্যোগপতি হিসাবে আয়াক্সে থাকা তারেক রানার সঙ্গে কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশি ডনের একের পর এক সা়দৃশ্যর হদিশ পান কানাডার পুলিশ কর্তারাও। ২০১১ সালে প্রথম বার কানাডা যান তারেক রানা। ২০১৪ তে তৈরি করেন সম্পত্তি কেনাবেচার ‘এসজে ৭১’ সংস্থা। সম্প্রতি ‘এসজে ৭১’-এর ডিরেক্টর তারেক রানার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তনভীরের সঙ্গে সব রকম মিল খুঁজে পেয়েছে কানাডা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। কী রকম? গোয়েন্দারা নির্দিষ্ট ভাবে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করছেন—
১) ২০০৫ সালে খোন্দকার তনভির ইসলাম ওরফে জয়ের যে ছবি ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিসে রয়েছে, তার সঙ্গে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া জয়ের ছবি এবং তারেক রানার সাম্প্রতিক ছবিতে সাদৃশ্য রয়েছে।
২। খোন্দকার তনভিরের বাবার নাম এবং তারেক রানার বাবার নাম এক— খোন্দকার নজরুল ইসলাম।
৩। খোন্দকার তনভির এবং তারেক রানার জন্মসাল এক— দু’জনেরই ১৯৬৭ সালে জন্ম।
৪। অতীতে দু’জনেরই দু’পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার চিহ্নও দু’জনের শরীরে রয়েছে।
শুধু কানাডার অভিবাসন দফতর নয়, সিআইডির আধিকারিকরা, যাঁরা জয়কে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতার করেছিলেন, তাঁরাও কানাডার তারেক রানার ছবি দেখে এক মুহূর্তে চিনতে পারছেন। তাঁরা নিশ্চিত, বাংলাদেশের কুখ্যাত ডন খোন্দকার তনভির ইসলামই আসলে এই তারেক রানা। সিআইডি যখন জয়কে চিনার পার্ক থেকে গ্রেফতার করে, তখন সে বাড়িতে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিল। গ্রেফতারের কয়েক দিন আগে বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। সে কারণে তাই জয়ের গ্রেফতারির পর এমআর বাঙুল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তাকে ভর্তি করেছিল সিআইডি। কানাডার অভিবাসন দফতরের কাছে ভারতীয় হিসাবে পরিচয় দেওয়া তারেক রানার ফাইলেও রয়েছে পায়ের অস্ত্রোপচারের তথ্য।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, জয়ের বিরুদ্ধে ব্যারাকপুর, কসবা, দমদম, তিলজলা এবং কাঁকসা থানায় পাঁচটি মামলা থাকার পরেও সে কী ভাবে জামিন পেল? জামিন পাওয়ার পর কী ভাবেই বা দেশ ছেড়ে পালাল? জবাব দিতে চাননি সিআইডির আধিকারিকরা। তবে তাঁদের এক জন শুধু ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ‘‘কানাডাতে ঠিক যে ভাবে প্রভাবশালীদের সঙ্গে ওঠাবসা করে উদ্যোগপতি হয়ে উঠেছিল জয় ওরফে তারেক রানা, ঠিক সেই মন্ত্রেই এই দেশ ছেড়েছিল বাংলাদেশের দাউদ।”তারেক রানা কী বলছেন এ বিষয়ে? কানাডার এই উদ্যোগপতি প্রথমে এ বিষয়ে কোনও কথা বলতেই রাজি হননি। গত অক্টোবরে শেষ বার যখন কথা হয়, তখনও তিনি কানাডাতে। এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘‘সম্প্রতি এটা আমারও অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। ওই অপরাধীর সঙ্গে আমার মুখের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। এখানকার পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।’’ একই সঙ্গে তিনি দাবি করেছিলেন, ‘‘তবে, আমি তনভির ইসলাম জয় নামে কাউকে চিনি না।”
ইন্টারপোলের জারি করা ‘রেড কর্নার নোটিস’।গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তাঁকে কি কখনও কলকাতায় গ্রেফতার করা হয়েছিল? তারেক দাবি করেন, তাঁর জীবনে কখনও কোনও অপরাধের সঙ্গে যোগ ছিল না। ফলে গ্রেফতারের প্রশ্নই নেই বলে জানিয়েছিলেন কানাডার ওই উদ্যোগপতি। তা হলে কলকাতা হাইকোর্টে ২০০৭ সালের অগস্ট মাসে খোন্দকার তনভির ইসলাম জয় ওরফে তারেক রানা (সিআরআর ২৮৮৭/২০০৭) হিসাবে তিনি কেন তাঁর বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে চলা মামলা খারিজ করার আবেদন জানিয়েছিলেন? সেখানে তো তারেক রানার সঙ্গে মোস্ট ওয়ান্টেড খোন্দকার তনভির ইসলাম জয় নামটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন। কেন? এ সব প্রশ্নের কোনও জবাব অক্টোবরের ওই কথোপকথনের সময়ে তারেক দেননি। তাঁকে এটাও সেই সময় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ওই মামলার নথি থেকে হদিশ মিলেছে, তারেকের যে ভারতীয় পাসপোর্ট (এফ ১১১৫১৩৪) তা আসলে ভুয়ো নথি দিয়ে বানিয়েছিল জয়— সিআইডি আদালতে তেমনটাই জানিয়েছিল। এ বারও নিরুত্তর ছিলেন তারেক। আর সিআইডি বলছে, ওই ভুয়ো পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তারেক রানা কানাডা যাওয়ার জন্য ১০ বছরের ভিসা পেয়েছিলেন!
অক্টোবরে তারেকের সঙ্গে যে দিন কথা হয়, তার কয়েক দিনের মধ্যেই কানাডার অভিবাসন দফতর একাধিক বার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর পর হঠাৎ করেই অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ তিনি ‘উধাও’ হয়ে যান। কানাডায় তাঁর পরিচিতদের তারেক জানিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। ২৮ নভেম্বরের মধ্যে তিনি ফিরবেন আয়াক্সে। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি কানাডায় ফেরেননি। তিনি কোথায় আছেন জানতে তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে ওই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, তারেক রানা বর্তমানে মালয়েশিয়ার কুয়ালা লামপুরে রয়েছেন। কানাডা পুলিশ জানাচ্ছে, তাঁর আয়াক্সের অফিস তালা বন্ধ। পাওনাদাররা টাকা না পেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
লিবারেল এমপি আহমেদ হুসেনের সঙ্গে তারেক রানা। ওই সময়ে হুসেন ছিলেন অভিবাসন দফতরের মন্ত্রী (ডান দিকে)। টাউন অব আয়াক্স থেকে তারেক রানাকে দেওয়া ২০১৮ সালের ‘অন্ত্রপ্রনর অব দ্য ইয়ার’ স্মারক (বাঁ দিকে)। ফেসবুক থেকে সংগৃহীত ছবি।
তবে কি ভোজবাজির মতোই মোস্ট ওয়ান্টেড ডন হয়ে গেলেন কানাডার ‘প্রতিশ্রুতিমান উদ্যোগপতি’ তারেক রানা! পর পর উঠে আসা তথ্যপ্রমাণ থেকে স্পষ্ট, কানাডার হোমরাচোমরাদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করা তারেকই জয়ের আর এক নতুন ‘অবতার’। যেমন কলকাতায় তার ‘অবতার’ ছিল পোশাক সংস্থার মালিক। কানাডায় তার ‘অবতার’ এসজে ৭১-এর ডিরেক্টর। সম্প্রতি কানাডার একটি শহরে পুর প্রশাসনের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন তারেক।
তবে রুমাল থেকে বেড়াল হয়ে উঠলেও তারেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি জয়ের সঙ্গে মিলগুলোকে মুছে ফেলা। ডন থেকে উদ্যোগপতি হয়ে উঠলেও গোয়েন্দা চোখের আড়ালে যাওয়া যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনই ফেরার হয়ে নিজেকে লুকনোও ক্রমশ মুশকিল হয়ে পড়ছে তাঁর। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই তার মোবাইল নিষ্ক্রিয়। ই-মেলও অকার্যকরী হয়ে রয়েছে। আর সেখানেই প্রশ্নটা উঠছে, তারেক যদি মোস্ট ওয়ান্টেড জয় না-ই হন, তবে নিজের এত বড় ব্যবসা ফেলে কেন ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গেলেন!