দলের দুই মুখের দুই বক্তব্য কেন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
একই দলের দু’রকম কথা। শুরু হয়েছিল সেই ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একই ভাবে বলে চলেছেন, কেন্দ্র রাজ্যের প্রাপ্য টাকা রাজ্যকে দিচ্ছে না। বকেয়া টাকার দাবিতে আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন। অন্য দিকে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার বলছেন— লাগবে না কেন্দ্রের টাকা! রাজ্য রাজ্যের মতো চালিয়ে নেবে।
আপাতদৃষ্টিতে ‘পরস্পরবিরোধী’ এই দুই বয়ান নিয়ে বিরোধীরা সরব। তৃণমূল কি খানিকটা বিভ্রান্ত? দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ অবশ্য দাবি করেছেন, এতে বিভ্রান্তির কিছু নেই। রাজ্যের দাবি নিয়ে সরব মুখ্যমন্ত্রী মমতা। আর অভিষেক বার্তা দিচ্ছেন, কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়াও রাজ্য চলতে পারে।কেন্দ্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের টাকা নিয়ে বিবাদ মূলত প্রকল্পের নামবদল নিয়ে। একটা সময়ে মমতাও রাজ্যের দেওয়া নামের পক্ষে সওয়াল করেছেন। কিন্তু বিজেপি ‘স্টিকার রাজনীতি’-র অভিযোগ তোলার পরে দেখা গিয়েছে প্রশাসন অনেক জায়গায় ফিরিয়ে এনেছে কেন্দ্রের দেওয়া নাম। ‘বাংলা আবাস যোজনা’ বা সড়ক যোজনায় ‘প্রধানমন্ত্রী’ শব্দটি ফিরে এসেছে। ১০০ দিনের কাজ নিয়ে বিবাদেও রয়েছে হিসাব না দেওয়ার প্রশ্ন। দিল্লি বনাম কলকাতার চিঠিচাপাটি তো বটেই, মমতার দাবিমতো তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলেছেন। রাজ্যের মন্ত্রীরাও একই দাবিতে দিল্লি গিয়েছেন।
কিন্তু অভিষেক গত ২১ জুলাই তৃণমূলের শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে বলেছিলেন, ‘‘দিল্লির কাছে হাত পাতবে না বাংলা। বাংলার টাকা বাংলা জোগাবে।’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘কেন্দ্র বাংলার টাকা বন্ধ করে দিয়েছে। ১০০ দিনের কাজের ৯ হাজার কোটি টাকা বন্ধ করেছে কেন্দ্র। সড়ক যোজনার সাড়ে চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকাও বন্ধ। বাংলা আবাস যোজনায় সাড়ে ছ’হাজার কোটি বন্ধ। বিজেপির নেতারা বলেছেন, মোদীকে বলে বাংলার টাকা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে বাংলার ক্ষতি ওঁরা করতে পারবেন না। বাংলার নিজের টাকা নিজেই জোগাবে।’’
এরই পাশাপাশি অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে সময় দিন। তবে কেন্দ্রের চাপে পড়ে আমরা মাথা নোয়াবে না। কেন্দ্র চেয়েছিল কেন্দ্রের নামে প্রকল্প করতে হবে, তবেই টাকা দেবে কেন্দ্র। কিন্তু অন্য দলগুলির মতো এই চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করিনি। আমরা বলেছি, বাংলার প্রকল্প হলে শুধু বাংলার নামেই হবে। বাংলা আবাস যোজনা হবে। বাংলা সড়ক যোজনা হবে। তাতে যদি কেন্দ্র টাকা না দিতে চায়, বাংলার সেই টাকা লাগবে না। বাংলা কেন্দ্রের ভরসায় ছিল না। থাকবেও না। বাংলাই নিজের রাস্তা নিজে বানাবে।’’
কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, নামবদল নিয়ে এখন নমনীয় নবান্ন। যদিও অভিষেক গত মঙ্গলবারও জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলার প্রয়োজনের টাকা বাংলাই মিটিয়ে নেবে। কেন্দ্রের টাকা চাই না।
ঘটনাচক্রে, একই দিনে মমতা ছিলেন ঝাড়গ্রামে। সেখানে তিনি কিন্তু সে কথা বলেননি। কেন্দ্র এবং বিজেপিকে আক্রমণে ঝাঁজ থাকলেও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা আদায় করে নেওয়াই অভিমত রাজ্যের। বিরসা মুন্ডার জন্মদিনে ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়িতে মঙ্গলবার একটি জনসভায় কেন্দ্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, ‘‘আমাদের থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের কোনও টাকা দিচ্ছে না। আমরা বলছি, হয় টাকা দিন, নয়তো জিএসটি তুলে নিন।’’ তিনি আরও বলেছেন, “রাজ্য থেকে জিএসটির নামে টাকা তুলে নিয়ে যায় কেন্দ্র। রাজ্য থেকে নিয়ে যাওয়া সেই টাকা থেকেই ১০০ দিনের কাজের জন্য দেয়। ১০০ দিনের কাজের টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র। এটা কারও দয়ার টাকা নয়, রাজ্যের প্রাপ্য।’’ ১০০ দিনের কাজের ভরসায় থাকা জনতাকে মমতা বলেন, ‘‘টাকা না দিলে আপনারা সকলে মিলে রাস্তায় নামুন। স্লোগান তুলুন— ১০০ দিনের টাকা ফেরাও! নইলে গদি ছাড়ো!’’
তৃণমূলের অনেকে বলছেন, অভিষেক রাজনীতির কথা বলছেন। আর মমতা বলছেন প্রশাসনের কথা। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা ঠিকমতো না এলে রাজ্যের পক্ষে প্রশাসন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। রাজ্য প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, গত প্রায় এক বছর ধরে ১০০ দিনের প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কবে সেই বরাদ্দ পুনরায় চালু হবে, তা নির্দিষ্ট করে এখনই কেউ বলতে পারছেন না। রাজ্যের দাবি, এই অবস্থায় বিভিন্ন দফতরের মাধ্যমে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের জবকার্ডধারীদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে রাজ্যকে। এখনও পর্যন্ত সেই ব্যবস্থায় ৬০০ কোটির বেশি টাকা খরচ করে ফেলেছে রাজ্য। কিন্তু এ ভাবে ১০০ দিনের কাজের মতো বড় প্রকল্প যে টানা চালানো সম্ভব নয়, তা বুঝছেন প্রশাসনের কর্তারা।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মাসিক টাকা ছাড়াও রাজ্যের নিজস্ব বেশ কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। সে বাবদ খরচও কম নয়। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী এমনও নির্দেশ দিয়েছেন যে, ১০০ দিনের শ্রমিকদের কাজে লাগানো যাবে, এমন কাজকর্মে বাড়তি জোর দিতে হবে। রাজ্যের দফতরগুলি যেন এই কাজে অগ্রাধিকার দেয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন মেলার খরচে রাশ টানারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ডিএ মামলায় রাজ্য যদি তাদের পক্ষে কোনও ‘ইতিবাচক’ নির্দেশ না পায়, তা হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে বলেই প্রশাসনিক মহলের একাংশের বক্তব্য।
তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়ের কথায়, ‘‘কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য টাকার পরিমাণ তো কম নয়! সেটা পাওয়া তো রাজ্যের অধিকার। দিতেই হবে। তার জন্য আন্দোলনও করতে হবে। সেই টাকা না পেলে প্রশাসন চালানো, সব খরচ বহন করা তো সম্ভব নয়। জিএসটির ভাগ ছাড়া তো রাজ্যের কোনও আয় নেই।’’ তবে অভিষেকের মন্তব্য নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘এ নিয়ে আমার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি। তাই আমি কিছু বলব না।’’
কুণাল অবশ্য সটান বলে দিয়েছেন, দুই দাবিতে কোনও সংঘাত নেই। তিনি বলেন, ‘‘দিতে হবে আর চাই না-র মধ্যে কোনও সঙ্ঘাত নেই। আমরা বলছি, কেন্দ্র টাকা দিতে বাধ্য! টাকাটা ওদের পৈর্তৃক সম্পত্তি নয়। বাংলা থেকেও টাকা উঠছে। কর দিচ্ছেন মানুষ। আমাদের টাকা দেবে না কেন? কিন্তু, ওরা না দিলেও মানুষের পরিষেবার টাকার ব্যবস্থা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করছেন। ওরা যদি মনে করে, টাকা দেওয়া বন্ধ করে ক্ষতি করবে, সেটা মমতাদি হতে দেবেন না। ফলে এই দুটো কথার মধ্যে কোথাও কোনও সংঘাত নেই।’’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার অবশ্য বলেন, ‘‘কেন্দ্র তো টাকা দেবে না, বলেনি। বলেছে, সঠিক নামে, সঠিক হিসাবে টাকা খরচ করতে হবে। মাননীয়া সেটা বুঝেছেন। নাম বদলাচ্ছেন, হিসাব বানাচ্ছেন। কিন্তু ভাইপোর তো কম বয়স। সেই উত্তেজনা রয়েছে। ক’দিন গেলেও উনিও বুঝবেন, কেন টাকা মিলছে না। কেন্দ্র তো বটেই, রাজ্যবাসীও বুঝিয়ে ছাড়বে। অহঙ্কার দেখিয়ে কাজ হবে না তখন!’’
খানিকটা একই সুর সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের। তিনি অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবে কেন্দ্রকেও দুষেছেন। সেলিমের কথায়, ‘‘পিসি আর ভাইপোর মধ্যে দূরত্ব বোঝা যাচ্ছে। সেটা দিন দিন বাড়ছে। তবে আমরা মনে করি, কেন্দ্র-রাজ্য দু’পক্ষই অসত্য বলছে। সত্যিটা বাংলার মানুষকে জানানো দরকার। তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে পায়ে ধরতে হবে না, কারও বাড়ির বাসনও মেজে আসতে হবে না।’’ সেলিমের আরও দাবি, ‘‘টাকা পাচ্ছি না বলে রাজ্য যেমন খুশি দাবি করে, তেমনই কেন্দ্র আরও ওস্তাদ! আমাদের দাবি, আর্থিক বরাদ্দ ও পাওনার বিষয়ে দু’পক্ষই শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক। রাজ্যের মানুষ জানুক প্রকৃত ছবি। বাংলার মানুষ নিজেদের হক বুঝে নেবে। দরকার হলে সেই লড়াইয়ে আমরাও পাশে থাকব।’’