তৃণমূল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরানের বিরুদ্ধে সারদার টাকা ব্যবহার করে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির যে অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত চলছে বলে জানিয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। আজ মন্ত্রকের একটি অনুষ্ঠানে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আইন আইনের পথেই চলবে। এতে আমরা কোনও হস্তক্ষেপ করব না।”
ইমরানের ‘সন্দেহজনক’ ভূমিকা নিয়ে রাজ্যের গোয়েন্দা, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা এমনকী বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থাও যে সংশ্লিষ্ট মহলে নিয়মিত সতর্কবার্তা পাঠিয়ে এসেছে, তার প্রমাণ মিলেছে ইতিমধ্যেই। এ বার খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তদন্তের কথা জানিয়ে দেওয়ায় আরও এক দফা অস্বস্তি বাড়ল তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের। রাজ্যের শাসক দল অবশ্য বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলে দাবি করেছে, ইমরান সংখ্যালঘু বলেই তাঁকে জড়িয়ে ‘অপপ্রচার’ চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি, দলীয় ওয়েবসাইটে আজ আনন্দবাজারকেও সরাসরি আক্রমণ করেছে তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্র বলছে, বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। কারণ, রাজ্যসভার এক সাংসদের বিরুদ্ধে দেশবিরোধী কাজের অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া, সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে সিবিআই, যারা কেন্দ্রীয় কর্মিবর্গ মন্ত্রক তথা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। বস্তুত, সেই কারণেই রাজনাথ আজ বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া এড়িয়ে যান বলে মন্ত্রক-সূত্রের বক্তব্য।
তবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানিয়ে দিচ্ছেন, ইমরানের ভূমিকা কখনওই সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল না। দীর্ঘদিন তিনি নিষিদ্ধ মৌলবাদী সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া (সিমি)-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি ছিলেন। ২০০১ সালে সিমিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কেন্দ্র। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মনে করে, তত দিনে সিমির শিকড় গোটা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। তলে তলে ভারত-বিরোধী কাজে এখনও সক্রিয় তারা। জঙ্গি কাজকর্মের জন্য টাকাও তুলছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের অনুমান, এই ধরনের কাজে ইমরানের মতো প্রাক্তন সিমি নেতারাও জড়িত।
এই সূত্রেই এসে পড়ছে ইমরানের সারদা-যোগ ও জামাত-যোগের প্রসঙ্গ। কেন্দ্রের গুরুতর জালিয়াতি তদন্ত সংস্থা বা এসএফআইও তাদের রিপোর্টে সম্প্রতি জানিয়েছে, সারদা গোষ্ঠীর টাকার একটি বড় অংশ আমেরিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় পাচার হয়ে গিয়েছে। হাওয়ালার মাধ্যমে বাংলাদেশ হয়ে ওই টাকা পাচার হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না কেন্দ্র। ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাচার হওয়া টাকার একটি অংশ তিনি দিয়েছেন জামাতে ইসলামির তহবিলে। সেই টাকা বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বলে গোয়েন্দাদের দাবি। সূত্র বলছে, বাংলাদেশে গণহত্যার অপরাধে কাদের মোল্লার ফাঁসি ঘোষণা হওয়ার পর ধর্মতলায় বেশ কিছু সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছিল। জামাত ও সিমির মদতেই ওই কাজ হয়েছিল এবং তাতে ইমরানের সক্রিয় ভূমিকা ছিল বলেই জানতে পেরেছে কেন্দ্র।
বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন অবশ্য আজ বলেছেন, “বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশন থেকে এই (ইমরান) সংক্রান্ত কোনও রিপোর্ট আমরা পাইনি। আজ বিকেল চারটে অবধি যোগাযোগে ছিলাম। তখনও পর্যন্ত রিপোর্ট আসেনি।”
আকবরউদ্দিনের কথার সূত্র ধরেই তৃণমূলের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, “বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়েছেন, তৃণমূলের টাকা বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে বলে আনন্দবাজারে যা প্রকাশিত হয়েছে তা সর্ম্পূণ ভুল।” তবে কূটনীতিবিদদের একাংশের বক্তব্য, দু’দেশের সম্পর্ক জড়িত, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে কখনওই নির্দিষ্ট করে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা হয় না। তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাবে জোর দিয়ে তদন্তের কথা জানিয়েছেন, তাতেই বিষয়টি স্পষ্ট।
বিবৃতির পাশাপাশি ইমরানের হয়ে বলার জন্য তৃণমূল আজ এগিয়ে দিয়েছিল দলের বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সংখ্যালঘু মুখ ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে। সংবাদমাধ্যম ‘অপ্রীতিকর ও অসত্য’ খবর করছে বলে অভিযোগ করে সুব্রতবাবুর দাবি, “জামাত-সিমিকে জড়িয়ে, আমাদের দলের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের কথা তুলে যে সব খবর প্রচার করা হচ্ছে, এত কুরুচিকর সংবাদ ইদানীং কালে দেখিনি!” ওই সব অভিযোগের পক্ষে তথ্যপ্রমাণ হাজির করার জন্য সংবাদমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জও করেছেন সুব্রতবাবু। না হলে তাঁরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন বলেও জানিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর অভিযোগ, “এর পিছনে বিজেপি রয়েছে। তারা প্রাদেশিকতা, সংঘর্ষ ছড়াতে চাইছে। প্রয়োজনে রক্ত দিয়েও দাঙ্গাবাজদের রাজনীতিকে আমরা রুখব!” কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো জামাত-যোগ নিয়ে তদন্তের কথা বলেছেন। সুব্রতবাবুর বক্তব্য, “তদন্ত হবে বলেছেন। তদন্তে কিছু প্রমাণিত হলে নিশ্চয়ই সাজা পাবে। কিন্তু তার আগেই ইমরানকে অপরাধী বানানো হবে কেন?” সুব্রতবাবুর থেকে এক ধাপ এগিয়েই ফিরহাদ বলেছেন, “সংখ্যালঘু বলেই ইমরানকে জড়িয়ে এ সব প্রচার হচ্ছে। তৃণমূল তাকে সাংসদ করেছে, এই অপরাধে বিজেপি সাধারণ ঘরের এক সংখ্যালঘু মানুষকে কালিমালিপ্ত করছে।”
এই অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজ্যে বিজেপির পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, “ওঁরা আদালতে গেলে ভালই হয়। আমি ওঁদের আদালতে স্বাগত জানাচ্ছি। সংখ্যালঘু বলে ইমরানকে আক্রমণ করার প্রশ্নই নেই। তিনি দেশদ্রোহিতায় যুক্ত। তাই তাঁর সমালোচনা করা হচ্ছে।” সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, “এগুলো চেনা রাজনীতির ছক! দুর্নীতিতে জড়িয়ে মায়াবতীও বলতেন, দলিত বলে তাঁকে নিশানা করা হচ্ছে। তৃণমূল বলছে, সংখ্যালঘু বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। বরং মুসলিম হিসেবেই ওই সাংসদের আরও ইমানদার হওয়া উচিত ছিল!” প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার বৃহত্তর পরিকল্পনায় যে ভাবে জামাতের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ হয়েছে, তা প্রতিরোধের চেষ্টা না করার জন্য রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, অর্থসচিব এবং অর্থমন্ত্রীর ভূমিকাকেও তদন্তের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন সেলিম।
এ দিকে, বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ইমরানের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁকে জঙ্গি বলে উল্লেখ করেছিলেন সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। শুক্রবার বেনিয়াপুকুর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ করেছেন ইমরান। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হবে।
কমিটি গড়ছেন হাসিনা
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা
জামাতে ইসলামির জঙ্গি আন্দোলন ও নাশকতায় সীমান্ত পারের অর্থ কী ভাবে, কোন পথে বাংলাদেশে ঢুকেছে, তা অনুসন্ধান করতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গড়ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের মৌলবাদীদের হাতে গিয়েছে শুক্রবার আনন্দবাজারে এই খবর প্রকাশের পরই তিনি এই কমিটি গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। শুক্রবার বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে তৎপর হয়েছেন সচিবরা। এক জন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর নেতৃত্বে কয়েক জন সাংসদ ও সচিবকে নিয়ে এই কমিটি গড়া হতে পারে বলে সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে। জঙ্গি কার্যকলাপ প্রতিরোধে আওয়ামি লিগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই একটি সরকারি কমিটি গড়েছেন হাসিনা। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও এই কমিটিতে রয়েছেন। তাঁদেরও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ভোটের স্বার্থে জঙ্গিদের নিয়ে রাজনীতি অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই এর মাসুল দিচ্ছে। দু’দেশের রাজনীতিকদেরই এই প্রবণতা থেকে দূরে থাকা উচিত।