কলকাতায় কি কেউ নিরালম্ব শীর্ষাসন করতে পারেন?
যেমন, করে দেখিয়েছেন বেল্লুর কৃষ্ণমাচার সুন্দররাজ আয়েঙ্গার। যেমন করতে পারেন, বিহার (মুঙ্গের) স্কুলের যোগশিক্ষকেরা। শীর্ষাসনের সময়ে স্রেফ ব্রহ্মতালুতে ভর দিয়ে দিব্যি দুই পা শূন্যে তুলে তাঁরা ইচ্ছেমতো স্থির থাকতে পারেন।
শনিবার সারা দিন খোঁজ করেও এই মহানগরে তেমন কোনও যোগশিক্ষক বা যোগাভ্যাস করা লোকের হদিস মিলল না। শহরের যোগ প্রশিক্ষকেরা অনেকেই বরং স্বীকার করলেন, নিরালম্ব শীর্ষাসন তাঁরা করেন না, শেখানও না।
অনেকেই বলছেন, ঘরানা ভিত্তিক যোগ অনেকটা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতোই। গুরুর কাছে প্রায় নাড়া বেঁধেই এই যোগাভ্যাসের শুরু হয়। আজীবন সেই ঘরানার শিক্ষা নিয়েই চলেন ছাত্র। তাঁর কাছ থেকে ঘরানা ছড়িয়ে যায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে যোগাভ্যাস ছড়ানোর জন্যই প্রয়োজন হয় প্রতিষ্ঠানের।
নিরালম্ব শীর্ষাসনে বেল্লুর কৃষ্ণমাচার সুন্দররাজ আয়েঙ্গার (বাঁ দিকে) ও শীর্ষাসনে জওহরলাল নেহরু।
কিন্তু এ শহরে তেমন যোগচর্চা হল কই? বিহার ঘরানা ও আয়েঙ্গার ঘরানা— যোগশিক্ষার এই দু’টি পরম্পরা কখনওই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আসেনি কলকাতায়। হয়তো বিক্ষিপ্ত ভাবে কেউ কেউ বিহার স্কুল বা আয়েঙ্গার স্কুল থেকে তালিম নিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই ওই ধরনের আসন করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাও শিষ্য তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কলকাতার যোগচর্চা সামগ্রিক ভাবে সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার খামতিই বহন করছে।
তা হলে বাঙালির যোগচর্চার উত্তরাধিকার কোথায় দাঁড়িয়ে ?
গত শতাব্দীর শুরুতে কলকাতায় গড়ে ওঠা যোগাসনের কেন্দ্র বিষ্ণুচরণ ঘোষের ‘ঘোষেজ কলেজ অব ফিজিক্যাল এডুকেশন’ বা চলতি ভাষায় বিষ্টু ঘোষের আখড়া। বিহার বা আয়েঙ্গার স্কুলকে অনুসরণ করেননি তিনি। তাঁর যোগশিক্ষা এসেছিল নিজের দাদা পরমহংস যোগানন্দের হাত ধরে। সেই হঠযোগের শিক্ষা বিষ্টু ঘোষ প্রয়োগ করেন বাঙালির নিজস্ব ঘরানাতে। বিষ্টু ঘোষের ছাত্রেরা অনেকেই বাঙালির যোগচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
১৯২৩ সালে সুকিয়া স্ট্রিটে তৈরি প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে কিন্তু খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছবি দেখা গেল না। ভর বিকেলে ছাদে প্রধানত মধ্যবয়সিনী মহিলা শিক্ষার্থীদের ভিড়। কেউ মেদ ঝরাতে আগ্রহী, কেউ বা এসেছেন গাঁটের কি কোমরের ব্যথা সারাতে। বিষ্টু ঘোষেরই শিষ্য মনোতোষ চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘সে-কালের মতো শিক্ষার্থী এখন কই!’’ বিষ্টু ঘোষের আখড়ার বর্তমান অধ্যক্ষ প্রেমসুন্দর দাসের কথায়, ‘‘এখন যোগচর্চা কেন্দ্রে বেশির ভাগ লোকই আসেন উচ্চ রক্তচাপ, ঘাড়ের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা, ডায়াবেটিস সারাতে।’’
প্রাচীন কালে মুনিঋষিরা যোগাভ্যাস করতেন দেহ নমনীয় রাখতে, সুস্থ থাকতে, মনকে শান্ত রাখতে। এ কালে তার সঙ্গে রোগ সারানোর ব্যবহারিক দিকও যোগ হয়েছে। ‘‘রোগ সারানোর জন্য যোগাসনকে কিছুটা হলেও পরিবর্তন করতে হয়েছে,’’ স্বীকার করছেন বিষ্টু ঘোষের শিষ্য মনোতোষবাবু। প্রেমসুন্দরবাবু বলেন, ‘‘চিকিৎসার জন্যই হঠযোগের সঙ্গে প্রাণায়ামও শেখাই আমরা।’’ যোগাসনকেন্দ্রিক চিকিৎসার দিকে ঝুঁকেছেন প্রাক্তন বিশ্বশ্রী তুষার শীলও। ফলে, নিরালম্ব শীর্ষাসনের মতো যোগচর্চা নিয়ে মাথা ঘামাতে ক্রমশ ভুলেই যাচ্ছে বাঙালি।
মনোতোষবাবু একটু ভেবে বললেন, এক কালে আমিও ওই ব্যায়াম শিখেছিলাম। কিন্তু এখন বয়সের ভারে আর পারি না! তাঁর দাবি, ‘‘আমার পরের প্রজন্মে কেউ এ ব্যায়াম আর শেখেননি।’’ আর প্রাক্তন মিস্টার ইন্ডিয়া রবীন চক্রবর্তী নিরালম্ব শীর্ষাসনের নাম শুনেই হেসে ফেলছেন। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা যোগ শিখতে আসছেন, তাঁরা তো বেশির ভাগই রোগী! তাঁদের পক্ষে নিরালম্ব শীর্ষাসন তো দূরের কথা, শীর্ষাসন করাই অসম্ভব।’’
দক্ষিণ কলকাতার সানি পার্কে যোগশিক্ষার আর একটি প্রতিষ্ঠানের যোগশিক্ষক পুরুষোত্তম কুমারও মানছেন, কলকাতায় যোগ চর্চা চললেও নিরালম্ব শীর্ষাসন করার মতো দক্ষতা বহু দিন দেখা যায় না। ‘‘ও সব কঠিন যোগাসন করতে ঢের বেশি নিষ্ঠা দরকার!’’— বলছেন তিনি। আর্ট অব লিভিং সংস্থার শাখার দুই শিক্ষক রিতিকা পেরিওয়া ও অদ্বিতীয়া মখোপাধ্যায়রাও বলছেন, ‘‘নিরালম্ব শীর্ষাসন করার মতো ছাত্র-শিক্ষক দেখিনি।’’ বিহার স্কুল বা আয়েঙ্গার স্কুল তাঁরা অনুসরণ করেন না বলেই জানাচ্ছেন ওই যোগশিক্ষকেরা।
বিষ্টু ঘোষের আখড়ায় প্রেমসুন্দরবাবু আক্ষেপ করছিলেন, যোগ নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কমেছে। সকলেই তড়িঘড়ি পেশীবহুল চেহারা তৈরি করতে চায়। অনেকেই মাল্টিজিমের দিকে ঝুঁকছেন। নিরালম্ব শীর্ষাসনের মতো যোগাসন শেখার আগ্রহটাই এখন উধাও!