(বাঁ দিকে) বিশ্বভারতীতে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। (ডান দিকে) শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা। নিজস্ব চিত্র
আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে উপাচার্যের বক্তৃতায় ভাষা দিবসের কথাই যেন কার্যত ‘গৌণ’ হয়ে উঠল। শ্রোতারা জানাচ্ছেন, নানা বিষয়ে নিজের ক্ষোভ জানানোর জন্যই যেন কার্যত শুক্রবারের মঞ্চকে বেছে নিয়েছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। তার জেরেই ফের বিতর্ক বেধেছে শান্তিনিকেতনে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চে এ ধরনের বিষয়গুলির উত্থাপন এবং তা প্রসঙ্গে উপাচার্যের বক্তব্যের সমালোচনায় সরব হয়েছেন ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপকদের একাংশ। নানা প্রসঙ্গে এ দিন নিজের ক্ষোভ উগরে দেন বিদ্যুৎবাবু। পড়ুয়া, অধ্যাপকদের একাংশের দাবি, ওই সমস্ত প্রসঙ্গ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের মঞ্চে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত
উপাচার্য এ দিন দাবি করেন এই ঘটনা নতুন নয়। তাঁর কথায়, ‘‘১৯১৫ সালে যখন গাঁধীজী বা পরবর্তীতে যখন হাজারিপ্রসাদ দ্বিবেদীরা শান্তিনিকেতনে এসেছেন তখনও তাঁরা হিন্দি ভাষাতেই উপাসনা মন্দিরে পাঠ করেছিলেন। তাই উপাসনা মন্দিরের এই ঘটনা বিশ্বভারতীতে নতুন কিছু না।’’ এ প্রসঙ্গে প্রবীণ আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, ‘‘কবে কী হয়েছে তা আমি জানিনা, তবে আমার জীবদ্দশায় আমি কখনও উপাসনা মন্দিরে হিন্দি গান বা হিন্দি পাঠ শুনিনি।’’
ব্যবসায়ী-বিশ্বভারতী বিবাদ
উপাচার্য বলেন, ‘‘ব্যবসায়ী সমিতি, যাদের সঙ্গে আমাদের কোনও লেনাদেনা নেই, তারাও আমাদের ঘেরাও করে গালিগালাজ করল।’’ মঙ্গলবার ব্যবসায়ী সমিতি পৌষমেলায় জমা দেওয়া সিকিয়োরিটি মানি ফেরতের দাবিতে বিশ্বভারতীর সেন্ট্রাল অফিস ঘেরাও করে। বোলপুর ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুনীল সিংহ বলেন, ‘‘বিশ্বভারতী যখন পৌষ মেলার টাকা নিয়েছে, তখন লেনদেন তো অবশ্যই আছে। আর আমরা কোনওভাবেই উপাচার্য বা অন্য কোনও আধিকারিককে গালিগালাজ করিনি।’’ কবিগুরু হস্তশিল্প উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক আমিনুল হুদা জানান, ‘‘উপাচার্য মিথ্যা কথা বলছেন। পৌষ মেলা ও মাঘ মেলায় অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার পর, আজ তা ফেরত না দিলে ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে বিক্ষোভ দেখানো অত্যন্ত স্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরা খারাপ ব্যবহারও করেননি।’’
এই প্রসঙ্গেই উপাচার্য এ দিন দাবি করেন তাঁর ও অন্য কয়েকজন আধিকারিকের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সমিতি যে লুটপাট ও এক মহিলাকে হেনস্থার অভিযোগ দায়ের করেছে, তাও সঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে আমিনুল বলেন, ‘‘পৌষমেলায় লুটপাটের প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। আর যে মহিলা নিগ্রহের মামলা দায়ের করেছেন তিনি ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে যুক্ত নন।’’
বামপন্থীদের অনুপস্থিতি
উপাচার্য তাঁর বক্তব্যে এ দিন বামপন্থী ছাত্র অধ্যাপকদেরও নিশানা করেন। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে পরিচয় দেন, সেই সকল ছাত্র অধ্যাপকরা আজকের অনুষ্ঠানে কোথায়?’’ তাঁর অভিযোগ, বিশ্বভারতীর বৈতালিক বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্র-অধ্যাপকরা প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন। এ প্রসঙ্গে এসএফআই নেতা এবং বিশ্বভারতীর অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র সোমনাথ সৌ বলেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের মারধর করার জন্য যে উপাচার্য মহাশয় আরেক দল ছাত্রদের উস্কানি দেন, সেই উপাচার্যে মহাশয়ের পাশে থাকা মানে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।’’ এক অধ্যাপক বলেন, ‘‘উপাচার্য অধ্যাপক সংগঠনের অফিসে তালা লাগিয়ে, ছাত্র আন্দোলন দমন করে যদি ভাবেন ওঁর অসুস্থ ভাষণ শুনতে তাঁরা হাজির হবেন তবে খুব ভুল করবেন।’’
সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ
এ দিন উপাচার্যের আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি সংবাদমাধ্যমও। তিনি নাম করে একাধিক সংবাদপত্রকে ধিক্কার জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, বিশ্বভারতী সম্পর্কে কোনও সদর্থক খবর তারা প্রকাশ করে না। হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার খবরও বিশদে প্রকাশ করা ঠিক হয়নি বলে দাবি করেন। ২৬ শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে পূর্বপল্লী ছাত্রাবাসে নিজেরই সংবিধান সংক্রান্ত বিতর্কিত মন্তব্যটির ক্ষেত্রেও তিনি ভুল সাংবাদিকতাকেই দায়ী করেন। বিশ্বভারতীর জনসংযোগ আধিকারিক অনির্বাণ সরকার বলেন, ‘‘যাঁরা বিশ্বভারতীর মধ্যে থেকে বিশ্বভারতীকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করছেন, বিশ্বভারতী তাদের ধিক্কার জানাচ্ছে।’’