প্রেরণা: ভিডিয়ো-বার্তায় এই মঞ্চের অতীতের ‘তারকা’ কার্তিক কালিন্দী। নিজস্ব চিত্র
নির্ধারিত সময়ের ৪৫ মিনিট আগে মঞ্চে হাজির প্রধান অতিথি। আর কয়েক মাস বাদেই দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে যিনি শপথ নেবেন। ২০০৩-এর ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সেলেন্স’-এর আসরে এ ভাবেই চলে আসেন মনমোহন সিংহ।
ঠিক তার পরের বছর এই মঞ্চে জীবনকৃতী সম্মানটুকু গ্রহণের জন্যই যেন অপেক্ষায় ছিলেন বৈকুণ্ঠপুর প্রাথমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক গোপালচন্দ্র পাত্র। অফুরান প্রাণশক্তিতে প্রধান অতিথি সনিয়া গাঁধীর হাত থেকে পুরস্কার নেন অক্সিজেন সিলিন্ডারসুদ্ধ হুইলচেয়ারে আসীন মাস্টারমশাই। গ্রামে ফিরে এর পরের দিনই তাঁর জীবনাবসান ঘটেছিল।
শনিবার সকালে দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল উৎকর্ষ পুরস্কারের আসরটি মনে করাল এমন বহু না-ভোলা পুরানো কথা। এই রোমাঞ্চকর পথ চলা শুরুর পরে জীবন গিয়েছে চলে সিকি সিকি শতকের পার। ১৯৯৭-এ দ্য টেলিগ্রাফ এডুকেশন ফাউন্ডেশন আয়োজিত বৃত্তিসম্মান জয়ী, বিশেষ ভাবে সক্ষম লোপামুদ্রা সরকারের কনটেন্ট রাইটার, এডিটর হওয়ার গল্পই অনুষ্ঠানের সুরটা বেঁধে দিয়েছিল। এনআরএসে প্রথম সিমেস্টারে টাকা দিতে না-পারা, কোভিড-যোদ্ধা ডাক্তার বরুণ হালদার, খেড়িয়া-শবর ঘরে প্রথম স্নাতক ছাত্রী রামানিতা শবরদের ভিডিয়ো-বার্তাও অনেক কিছু বলে গেল। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বার্তা দিলেন পদার্থবিদ্যার কৃতী ‘ফুলব্রাইট স্কলার’ পৌলমী নন্দী। আইআইটি-র ডিপ্লোমাধারী দুর্গাপুরের কুষ্ঠ কলোনির কার্তিক কালিন্দীর স্বনির্ভরগোষ্ঠী গড়ার লড়াইও এক বন্ধনীতে ধরা পড়েছে। আড়াই দশকে এমন কত জীবন বদলানোর শরিক এই পুরস্কার-আসর। সঞ্চালক ব্যারি ও’ব্রায়েনের উপলব্ধি, ‘‘উত্তরণের লড়াইয়ে পাশে দাঁড়ালে আসলে নিজেদেরই উত্তরণ ঘটে।’’
বাস্তবিক পাকস্থলীর সমস্যায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় খিদে পাওয়া এক মেয়ের থেকে এই আসর শিখেছে, কেন খাবার নষ্ট করতে নেই। খড়কুটোর মতো জীবনকে আঁকড়ে ধরার মন্ত্র শুনিয়েছিল, ওড়িশার সুপার সাইক্লোনে একলা ভেলায় ভেসে প্রাণপণে বেঁচে থাকা পাঁচ বছরের শিশু অশোক। মেদিনীপুরে পোড়ামাটির মন্দির-ঐতিহ্য বাঁচাতে মরিয়া পাঁচ ওয়ক্ত নমাজি ইয়াসিন পাঠান বা ভিক্ষের চাল বেচা টাকায় হুগলির গ্রামে স্কুলের পত্তনকারী সুকাই চাচা-র ‘সত্যি রূপকথা’রও সাক্ষী এই অনুষ্ঠান।
এমন উত্তরাধিকার সজীব এই অতিমারির দিনেও। ৬৫ বছর ধরে স্কুলশিক্ষায় ব্রতী, বাংলার দিদিমণি, নামী ইংরেজি মাধ্যমের প্রাক্তন প্রধানশিক্ষিকা ৯০ বছরের ছায়া বিশ্বাস সম্মাননা পেলেন। লাডলো চটকলের ইস্কুলে অনলাইন ক্লাস নেওয়াটা এই করোনাকালেই ‘ছায়াদি’ রপ্ত করে ফেলেছেন।
অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার গল্পগুলোও ফুরোয়নি এই দুর্যোগে। হলদিবাড়ির দিনমজুর ঘরের সন্তান ইন্দ্রজিৎ রায় লস্কর ডাক্তারিতে সুয়োগ পেয়েছেন। বেলদার ভাগচাষির মেয়ে, ক্যানসারে বাঁ পা খুইয়ে অপরাজেয় প্রেরণা রানাও এনআরএসে ডাক্তারি পড়ছেন। উদ্যোক্তারা তাঁদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ালেন। মহম্মদবাজারে ভূগোল অনার্সের ছাত্রী, প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া জ্যোতি মারডিও সহায়তা পেলেন। এবিপি গ্রুপের স্কুলে ভর্তিবিষয়ক পোর্টাল অ্যাডমিশনট্রি.ইনও পাশে দাঁড়িয়েছে কোভিডে পিতৃহারা কাজল দাসের। বড়িশার নিম্নবিত্ত ঘরের স্কুলছাত্রী এখনই জীবনের কাছে হার মানতে নারাজ।
সুনামিতে দুঃসাহসী কন্যাকুমারীর তিন মৎস্যজীবী, করাচির স্নেহময়ী শিক্ষয়িত্রী পরভিন কাসিম থেকে কপিলদেবকেও অতিথি হিসেবে পেয়েছে এই অনুষ্ঠান। বিশেষ ভাবে সক্ষম ‘তারকা-শিশু’র ঝাঁক বা অপরাজেয় কন্যাসন্তানেরা মাত করেছে এই মঞ্চ। দু’টি পা ছাড়া ইংলিশ চ্যানেলজয়ী মাসুদুর রহমান এবং তুষারের কামড়ে পাঁচটি আঙুল হারিয়ে কনিষ্ঠতম এভারেস্টজয়ী কিশোর তেম্বাশিরি শেরপার এখানেই দেখা হয়েছিল। এ বার ‘তারকা’দের উপস্থিতি শুধু ছবি বা ভিডিয়োয়। তাও গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করল। এই আসরে পড়াশোনা, খেলাধুলো, গানবাজনায় কৃতীর তালিকাও বিশেষ গৌরবের। এ বার সেরা সম্মান প্রাপক হেরিটেজ স্কুল এবং দিল্লি পাবলিক স্কুল মেগাসিটি। তবু স্মার্টফোন বিলিয়ে বস্তিতে বস্তিতে অনলাইন শিক্ষায় ব্রতী ক্যালকাটা রেসকিউ স্কুল বা অতিমারিতে ১০০০ শয্যার হাসপাতালের রূপকার বারাসতের অ্যাডামাস ওয়র্লড স্কুলও মর্যাদায় কম গেল না। সমাজসেবায় চৌরঙ্গি স্কুল, দার্জিলিংয়ের সেন্ট জোসেফ নর্থ পয়েন্ট, মন্দারমণির কাছে অন্ত্যোদয় আশ্রম, টেরিটিবাজারের বাতিঘর পাঠশালা থেকে ডনবস্কো লিলুয়ার ভূমিকাকেও এই মঞ্চ কুর্নিশ করেছে। অতিমারি পার করে আগামী দিনে ছন্দে ফিরে আসার সঙ্কল্পও এই মঞ্চে ফুটে উঠল।