রাতের বিমানে শহরে আনা হল রুইয়াকে। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।
আজ ‘সাহেবে’র জন্মদিন। দিল্লির সুন্দরনগরের বাড়িটা তাই সাজানো হয়েছিল ফুল দিয়ে। আয়োজন ছিল সকালে পুজোরও। কিন্তু পুরোহিতের প্রায় পিছন পিছন গিয়ে দিল্লির সেই বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন কলকাতার সিআইডি গোয়েন্দারা।
প্রথমে তাঁদের ঢুকতে বাধা দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। পরিচয় দেওয়ার পরে বলা হয়, ‘সাহেব বাড়ি নেই।’ শুনে এক রকম জোর করেই বাড়িতে ঢোকেন অফিসারেরা। বাইরে রয়ে যান দুই গোয়েন্দা-অফিসার। বিশাল বাড়ির কোথায় ‘সাহেব’ লুকিয়ে রয়েছেন, তা প্রথমে বোঝা যায়নি। এক অফিসার পরে জানান, খোঁজ করতে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, ঘর লাগোয়া একটি শৌচাগারে লুকিয়ে আছেন ‘সাহেব’। কিন্তু পৌঁছনোর আগেই উধাও তিনি।
গোয়েন্দারা বলছেন, যাঁকে ধরতে এই অভিযান, তিনি অঘটনের আঁচ পেয়েছিলেন। তাই কড়া নাড়ার শব্দ পেয়েই প্রথমে ঢুকে পড়েন শৌচাগারে। কিন্তু সেখানে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। তাই শৌচাগারের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এক পরিচারকের ঘরে লুকিয়ে পড়েন। বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয় দরজায়।
এত কিছু করেও অবশ্য শেষ রক্ষা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ দরজার সামনে পৌঁছে যান গোয়েন্দারা। চাবি না পেয়ে শেষে শাবল দিয়ে চাড় মেরে ভাঙা হল দরজা। জন্মদিনের সকালে সেখান থেকেই গ্রেফতার হলেন ডানলপ ও জেসপের কণর্ধার পবন রুইয়া। রেলের সঙ্গে প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে।
শনিবার সকালে গ্রেফতার ঘিরে এই নাটকের পরে রাতের বিমানেই পবন রুইয়াকে কলকাতায় আনা হয়েছে। আজ, রবিবার তাঁকে ব্যারাকপুর আদালতে তোলা হবে।
শনিবার পবন রুইয়া গ্রেফতার হয়েছেন শুনে আনন্দে আবির খেলেন দমদমে জেসপের কর্মীরা। এক কর্মীর অভিযোগ, জেসপের ৪৯৮ জন কর্মীর প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি বাবদ প্রায় ২০ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। ওই টাকা আদায় এবং পবনের কঠিন শাস্তির দাবি জানান তাঁরা। হুগলির সাহাগঞ্জের ডানলপ কর্মীরাও এ দিন পবনের বিরুদ্ধে পৃথক তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, ডানলপের অন্তত ৪৪৩৫ জন কর্মীর বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সেই অভিযোগ নিয়ে কর্মীরা শীঘ্রই দরবার করবেন।
কেন গ্রেফতার করা হল পবন রুইয়াকে?
গত অক্টোবরে দমদমের জেসপ কারখানায় আগুন লাগার পরে দেখা যায়, কারখানা থেকে প্রচুর যন্ত্রাংশ এবং লোহালক্কর উধাও। চুরি এবং আগুন লাগার ঘটনায় জেসপ কর্তপক্ষের বিরুদ্ধে দমদম থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সবক’টি মামলার তদন্ত শুরু করে সিআইডি। অভিযোগ, বেশ কয়েক বার সমন পাঠিয়ে পবনকে ডেকে পাঠানো হলেও তিনি আসেননি। বার বার জেরা এড়িয়ে গিয়েছেন।
সিআইডি জানিয়েছে, ওই তদন্ত চলাকালীন রেল মন্ত্রক দাবি করে, বাতানুকূল ওয়াগন তৈরির জন্য ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জেসপকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার লোহা এবং ইস্পাত দিয়েছিল তারা। অভিযোগ, জেসপ ওয়াগান তৈরি করেনি, টাকাও ফেরত দেয়নি। তার উপর দেখা যায়, অধিকাংশ যন্ত্রাংশই চুরি হয়ে গিয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, এর পরেই ২৫ নভেম্বর রেলের তরফে জেসপ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ দায়ের করা হয়। রেলের তরফে নতুন করে এই অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেই পবনকে গ্রেফতার করতে আসরে নামে সিআইডি।
এক গোয়েন্দা কর্তা জানিয়েছেন, ক’দিন আগে জানা যায়, কয়েক সপ্তাহ দিল্লির বাইরে কাটানোর পরে সম্প্রতি পবন সুন্দরনগরের বাড়িতে ফিরেছেন। সেই মতো বৃহস্পতিবার গোয়েন্দাদের একটি দল ট্রেনে দিল্লি রওনা দেয়। কিন্তু কুয়াশার কারণে দলটি শুক্রবার দিল্লি পৌঁছতে পারেনি। তাই গোয়েন্দাদের অন্য একটি দলকে ওই দিনই বিমানে দিল্লি পাঠানো হয়।
এক গোয়েন্দা কর্তা জানান, জেসপে আগুন এবং চুরির মামলাতেও পবনকে হেফাজতে নেবে সিআইডি। জানতে চাওয়া হবে, বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কী করে কারখানার ভিতরের মাল উধাও হয়ে গেল।
এ দিন পবন রুইয়ার সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, জেসপ এ্যান্ড কোম্পানির কোনও পদে ছিলেন না পবন। তিনি ডিরেক্টর কিংবা অংশীদারও ছিলেন না। সংস্থার মুখপাত্র বলেন, ‘‘আমরা বুঝতে পারছি না, কেন তাঁকে এই মামলায় জড়ানো হল। এই সব অভিযোগের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদ্ধতিতে লড়াই হবে।’’
কেন গ্রেফতার
রেলের অভিযোগ
• ৫০ কোটি টাকার কাঁচামাল দেওয়া হয়েছিল জেসপকে।
• চুক্তি মতো বাতানুকূল ওয়াগন তৈরি করেনি জেসপ, দেয়নি হিসেবও।
• দমদমের কারখানায় তল্লাশি চালিয়েও ওই কাঁচামাল মেলেনি।
• প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ দমদম থানায়।
অন্য অভিযোগ
• জেসপে আগুন লাগানো এবং চুরি।
• কর্মীদের পিএফ-এর টাকা জমা না দেওয়া।