সভায় বক্তব্য। নিজস্ব চিত্র
২০১৭: হিন্দুস্তান কেব্লস।
২০১৮: বার্ন স্ট্যান্ডার্ড।— গত দু’বছরে দু’টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়াও আসানসোল ও দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-ক্ষেত্র ধুঁকছে। এই পরিস্থিতিতে শনিবার দুর্গাপুরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভার দিকে তাকিয়ে ছিল পশ্চিম বর্ধমানের শ্রমিকেরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাঁদের জন্য আশার কথা কিছু থাকল না, মনে করছেন শ্রমিক নেতৃত্ব।
শুধু আসানসোলই নয়, দুর্গাপুরের শিল্প-ক্ষেত্রেও গত কয়েক বছরে অবস্থা খারাপ হয়েছে বলে মনে করছেন শ্রমিকেরা। যেমন, অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট (এএসপি)। এই কারখানার কৌশলগত বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরেই সরব জেলার শ্রমিক সংগঠনগুলি। গত বছরের ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ইস্পাতমন্ত্রী চৌধুরী বীরেন্দ্র সিংহ দুর্গাপুরে এসে এএসপি-র ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন।
এ ছাড়া ‘মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারি কর্পোরেশন’ (এমএএমসি) ও ‘হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন লিমিটেড’ (এইচএফসিএল), দুর্গাপুরের এই দুই বড় কারখানাও বন্ধ। কলকাতা হাইকোর্টে নিলামে সর্বোচ্চ একশো কোটি টাকা দর দিয়ে ২০১১ সালে এমএএমসি-র দায়িত্ব পায় তিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, ‘ভারত আর্থ মুভার্স লিমিটেড’ (বিইএমএল), ‘কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড’ (সিআইএল) ও ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন’ (ডিভিসি)-এর কনসোর্টিয়াম। জেলার শ্রমিক নেতৃত্ব জানান, দেশে সারের ঘাটতি মেটাতে দুর্গাপুর-সহ দেশের মোট আটটি বন্ধ সার কারখানা নতুন করে চালু করার পরিকল্পনায় ২০১১-য় সায় দেয় অর্থনীতি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি। দেশের এমন তিনটি বন্ধ কারখানা সরকারি উদ্যোগে খোলার প্রক্রিয়াও চলছে।
শ্রমিকদের অভিযোগ, আশ্বাস অনেক মিলেছে। কিন্তু বন্ধ কারখানা খোলা বা রুগ্ণ কারখানার পুনরুজ্জীবনে এ যাবৎ কোনও পদক্ষেপ করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি, দেশের বন্ধ সার কারখানাগুলি খোলার কথা হলেও দুর্গাপুরের এইচএফসিএল-এর বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নীরবই। এ ছাড়া বহু বছর ধরে চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা, বার্নপুর ইস্কো-সহ একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানায় স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ।
এই পরিস্থিতিতে জেলার রাষ্ট্রায়ত্ত ভারী শিল্প-ক্ষেত্রে নতুন দিশার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দিকে তাঁরা তাকিয়ে ছিলেন বলে জানান শ্রমিক এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব। কিন্তু সভায় তা নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করেননি প্রধানমন্ত্রী।
শিল্প-ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা প্রসঙ্গে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, ‘‘সরকারে আসার আগে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, দু’কোটি চাকরি হবে। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে এই জেলার রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বন্ধ হয়েছে। বন্ধের মুখে খনি। বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। শিল্পাঞ্চলে এসেও তিনি এ সব নিয়ে একটিও কথা বললেন না। এর জবাব মানুষ দেবে।’’ সেই সঙ্গে মলয়বাবুর দাবি, ‘‘রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে বাঁচাতে রাজ্য সরকার চেষ্টা করে। জেলায় কর্মসংস্থান হচ্ছে। উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও।’’ সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমও বলেন, ‘‘নতুন শিল্প দূর অস্ত্, দুর্গাপুরে এসে এই শিল্পাঞ্চলের বন্ধ বা রুগ্ণ কারখানার পুনরুজ্জীবন নিয়ে কোনও কথা বললেন না প্রধানমন্ত্রী। চিত্তরঞ্জনের সিএলডব্লিউ থেকে বরাত বারাণসীর ডিলডব্লিউ-তে চলে যাচ্ছে।’’ ঘটনাচক্রে প্রধানমন্ত্রীর লোকসভা কেন্দ্র এই বারাণসী।
বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলিও। সিটুর জেলা সম্পাদক বংশগোপাল চৌধুরীর অভিযোগ, ‘‘একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। সেই সঙ্গে দুই শিল্পশহর আসানসোল ও দুর্গাপুরের অর্থনীতিও ধুঁকছে। আমরা ভেবেছিলাম শনিবার প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কোনও কথা বলবেন। আমরা হতাশ।’’ আইএনটিটিইউসি-র জেলা চেয়ারম্যান ভি শিবদাসনের অভিযোগ, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এটা পরিষ্কার, শিল্পাঞ্চলের কিছুই পাওয়ার নেই।’’
কয়লা উত্তোলনে দেশের অন্যতম প্রধান এলাকা এই জেলা। এলাকার খনিগুলিতে সব মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু সম্প্রতি ১৬টি কয়লাখনি বন্ধ করার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সভার দিকে তাকিয়ে ছিলেন খনিকর্মীরাও। আইএনটিইউসি অনুমোদিত খনিশ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় সম্পাদক চণ্ডী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘কয়লা-মন্ত্রক খনিগুলি শেষ করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী কিছুই বললেন না এ বিষয়ে। তা ছাড়া এই অঞ্চলের অন্যতম সমস্যা ধস নিয়েও তিনি নীরব। আমরা আশাহত।’’
তবে আশাহত নন বিএমএসের রাজ্য সম্পাদক উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে নানা সুবিধার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর সুবিধা পাবে এই শিল্পাঞ্চলও।’’