(বাঁ দিক থেকে) মরিয়ম ওয়ালি, পবিত্র ঘোষ ও কুলেশপ্রসাদ চক্রবর্তী।
ফরিদপুরের মাদারিপুরে বসে সেই দিনটায় খুশি সামলাতে পারছিলেন না তাঁরা। বড়দের মুখে শুনে ১৬ বছরের পবিত্র ঘোষ নিশ্চিত ছিলেন, এ সব ‘টেম্পোরারি’, মাদারিপুর ঠিকই ইন্ডিয়ায় আসবে।
এর কয়েক মাসের মধ্যেই খুব ভয়ে লটবহরসুদ্ধ শিয়ালদহে নামতে হয়েছিল তাঁদের। পরে ভারতীয় বায়ুসেনার সার্জেন্ট হয়ে পাকিস্তান যুদ্ধেও গিয়েছেন পবিত্র। কিন্তু স্বাধীনতা শুনলে স্রেফ কলকাতায় জেঠুর বাড়ির লাঠিঝাঁটার আশ্রয়টাই তাঁর মনে পড়ে যায়।
ঠিক একই সময়ে পার্ক সার্কাস মোড়ের চাচার বাড়ির আশ্রয়ে বছর এগারোর মরিয়ম ওয়ালিও দেখছিলেন, আশপাশের অনেকেই অন্য ঠিকানায় পাড়ি দিচ্ছেন। বাবা ব্যারিস্টার ওমরুদ্দিন আহমেদ বুক ঠুকে বলেন, কোত্থাও যাব না, আমার মাটি এখানেই হবে! কিন্তু হরিশ মুখার্জি রোডে নিজের বাড়ি, জাস্টিস চন্দ্রমাধব ঘোষের বাড়ির সমবয়সি মেয়েদের থেকে দূরে ১৫ অগস্ট ‘এ কোন দেশি স্বাধীনতা’ মাথায় ঢুকছিল না মরিয়মের।
এখন ৮৬, এ শহরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা, বাঙালিনি মরিয়মের জীবনটা নিজের শহরেই কেটেছে। কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর্বে কয়েক বছরের ঝড়ে বয়স অনেকটাই বেড়ে যায় স্কুলবালিকার।
১৪ অগস্ট শেষের অলৌকিক মধ্য রাতে এ দেশে যাঁরা জন্মেছিলেন, তাঁদের জীবন ইতিহাসের হাতকড়ায় বন্দি আখ্যা দেন সলমন রুশদি। কিন্তু আজকের ৭৫-৭৬-এর কোঠার কারও সেই মুহূর্ত মনে রাখা সম্ভব নয়। আবার কৈশোর বা প্রথম যৌবনে স্বাধীনতার সাক্ষী যাঁরা, প্রায় দ্বিতীয় শৈশবে তাঁরা। গুটিকয়েক ব্যতিক্রমই স্মৃতিভারে ইতিহাসের আনন্দ বা যন্ত্রণাকে বয়ে চলেছেন। ৯৮ ছুঁই ছুঁই কুলেশপ্রসাদ চক্রবর্তীর কথা খানিক অস্পষ্ট, তবু সব শোনেন, বোঝেন, সজাগ চেতনায়! কোথায় আপনার দেশ? শুনে শিশুর মতোই খলখল হাসেন তিনি।
কলকাতার গল্ফগ্রিনবাসী, ত্রিপুরা সরকারের প্রাক্তন সচিব কুলেশপ্রসাদ। জন্ম কিশোরগঞ্জে, যেখানে উৎসবে-পার্বণে আত্মীয়েরা জড়ো হতেন। কিন্তু দেশ বলতে পাহাড়ি দেশ ত্রিপুরার খোয়াইটাই মনে হতো। কলকাতার কলেজ জীবনে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু, বোমাতঙ্কের স্মৃতি। ৭৫ বছর আগের দিনটায় তিনি স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে ছিলেন মনে আছে কুলেশপ্রসাদের। সহাস্যে বলেন, “আমরা জানতাম ত্রিপুরারাজ ইন্ডিয়ায় যোগ দেবেন। কিন্তু প্রথম স্বাধীনতা দিবসে খোয়াইয়ে পতাকা তোলার প্রশ্নই ছিল না।”
স্বাধীনতার আগের পৃথিবীটাই বরং ঢের ভাল মনে হয় ১৯৪৭-এর শেষ দিকে কলকাতায় সদ্য স্কুল ফাইনাল দিয়ে আসা পবিত্রের। “মাদারিপুরে থাকতে কখনও অশান্তির আঁচ পাইনি। বাবা চাকরি বদলে কলকাতায় এলেন। ক্রমশ পাকিস্তানে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়টাও চেপে ধরল। কিন্তু কাঠখড় পুড়িয়ে কলকাতায় এসে নিজেদের নিঃস্ব, রিক্তই মনে হত।” বছর দুয়েকের মধ্যে বায়ুসেনার চাকরিটাই তাঁদের জীবন পাল্টায়, বলছিলেন পবিত্র। তবে ৯০ উত্তীর্ণ প্রবীণের সোজা কথা, পরে ঘুরে দাঁড়ালেও ৭৫ বছর আগের ক্ষতের ব্যথা এখনও টনটনে।
আর বেকবাগানের ফ্ল্যাটে বসে মরিয়ম হাসেন, ‘‘ভবানীপুরের বাড়িতে আমাদের ভাড়াটে চন্দবাবুরা না-থাকলে আজ তোমার সঙ্গে বসে কথাই হতো না!’’ ছেচল্লিশের এক সকালে ছাদে খেলতে খেলতেই পাশের কাজীপাড়া বস্তির আগুন, জনৈক ছুরিবিদ্ধ টুপিধারীকে ছুটতে দেখেন তিনি। চন্দবাবু রাতে জোর করে তাঁদের নিজের ঘরে এনে ভবানীপুরের বাড়িটায় তালা লাগিয়ে দিলেন। তাঁদের খোঁজে আসা দুর্বৃত্তদেরও তিনিই সামলেছিলেন। পার্ক সার্কাসের আশ্রয়ে স্থানীয় একটি হিন্দু পরিবারের পাশে থাকতে মরিয়মের বাবা ওমরুদ্দিন সাহেবকেও একই ভূমিকা নিতে হয়। মরিয়ম হাসেন, “ছোরা হাতে গুন্ডাদের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা দিব্যি বললেন, আমি সাচ্চা মুসলমান বলছি, এখানে একজনও হিন্দু নেই। মিথ্যে বলেই হিন্দু পরিবারটির একটি শিশুর জন্য বাবা গুন্ডাদের দিয়েই বেবিফুডের ব্যবস্থাও করে ফেললেন!”
দেশটা যা হয়েছে, তার জন্য আশা, হতাশা দু’টোই এখন একাকার। কুলেশপ্রসাদ, পবিত্র ভুলতে পারেন না, শুধু আজাদি নয় দেশ হারানোরও এটা ৭৫ বছর। মরিয়মের আত্মীয়েরাও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আমেরিকায় ছিটকে। বলেন, “তাজ্জব লাগে, আমার দেশে কে কোথায় থাকবে, সেটা ফের এক দল নেতা ঠিক করতে চাইছে! তবে মানুষে মানুষে ঘৃণা যত দেখেছি, ভালবাসাও তো কম দেখলাম না!”