মধ্যমগ্রাম-কাণ্ড

মিটমাটের টোপ ফেলেই জোড়া খুন

মোবাইলে পরের পর ফোন। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সময় মেলানো। শেষে মোক্ষম মুহূর্তে মারণ হামলা। এ ভাবে রীতিমতো ছক কষেই বৃহস্পতিবার মধ্যমগ্রামে বাবু সেন ও তার সঙ্গী নুঙ্কাইকে গাড়ির মধ্যে গুলি করে মারা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ-সূত্রের খবর, ঘটনার তদন্তে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ আর এক জমি-মাফিয়ার নামও উঠে এসেছে। মধ্যমগ্রাম-হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে বিশ্বজিৎ সাহা নামে হৃদয়পুরের এক প্রোমোটারকে শুক্রবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এই জোড়া খুনের নেপথ্যে আরও বড় মাথা জড়িয়ে রয়েছে। আপাতত মধ্যমগ্রামের কয়েক জনকে আটক করে জেরা করা হচ্ছে। বেলঘরিয়া ও লেকটাউনের দুই জমি-মাফিয়াকে পাকড়াও করতে ইতিমধ্যে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে পুলিশ।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০৩:২৪
Share:

মোবাইলে পরের পর ফোন। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সময় মেলানো। শেষে মোক্ষম মুহূর্তে মারণ হামলা।

Advertisement

এ ভাবে রীতিমতো ছক কষেই বৃহস্পতিবার মধ্যমগ্রামে বাবু সেন ও তার সঙ্গী নুঙ্কাইকে গাড়ির মধ্যে গুলি করে মারা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ-সূত্রের খবর, ঘটনার তদন্তে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ আর এক জমি-মাফিয়ার নামও উঠে এসেছে।

মধ্যমগ্রাম-হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে বিশ্বজিৎ সাহা নামে হৃদয়পুরের এক প্রোমোটারকে শুক্রবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এই জোড়া খুনের নেপথ্যে আরও বড় মাথা জড়িয়ে রয়েছে। আপাতত মধ্যমগ্রামের কয়েক জনকে আটক করে জেরা করা হচ্ছে। বেলঘরিয়া ও লেকটাউনের দুই জমি-মাফিয়াকে পাকড়াও করতে ইতিমধ্যে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে পুলিশ।

Advertisement

পুলিশ-কর্তাদের একাংশ মনে করছেন, এলাকার দখলদারি ও সিন্ডিকেট-রাজের রাশ কব্জা করার টক্করেরই পরিণতি এই খুন। এবং তার পিছনে পরিকল্পনার বহর দেখে দুঁদে অফিসারেরাও তাজ্জব বনে গিয়েছেন। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব মেটানোর কথা বলে বাবু সেনকে মধ্যমগ্রামে ডেকে আনা হয়েছিল। বাবু সেই ফাঁদেই পা দেয়। কী রকম?

উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী এ দিন জানিয়েছেন, কামারহাটির আড়িয়াদহের একটি জমিতে প্রোমোটিং নিয়ে বাবু সেনদের সঙ্গে কামারহাটির আর এক সিন্ডিকেটের কোন্দল বেঁধেছিল। মিটমাট করতে মধ্যমগ্রামের একটি সিন্ডিকেট নাক গলায়। ঘটনায় ধৃত বিশ্বজিৎ ছাড়াও ‘পদা’ নামে এক দুষ্কৃতী সেই সিন্ডিকেটের সদস্য। পুলিশের দাবি, পদার কথা মতোই বাবু সেন ওরফে তারক ঘোষ বৃহস্পতিবার মধ্যমগ্রামে আসে ‘মিটমাট’ করতে। ফেরার পথে আততায়ীরা ওত পেতে ছিল। সন্ধে সাতটা নাগাদ মধ্যমগ্রাম উড়ালপুলে ওঠার মুখে গাড়ি আটকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় বাবু সেন ও নিতাই পাল ওরফে নুঙ্কাইকে। বাবুদের কোমরেও পিস্তল গোঁজা ছিল। কিন্তু এত দ্রুত পর পর গুলি ছোড়া হয় যে, অস্ত্র বার সময়ই পায়নি ওরা।

বস্তুত খুনিরা যে দুর্দান্ত পেশাদার, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে সে ইঙ্গিত পেয়েছে পুলিশ। পিস্তল খালি হয়ে যাওয়ার পরে রাস্তায় দাঁড়িয়েই ম্যাগজিন পাল্টে তারা ফের গুলি চালিয়েছে! ঘটনাস্থলে চারটে গুলি ভর্তি একটি ম্যাগজিনও পুলিশ কুড়িয়ে পেয়েছে।

তদন্তে নেমে পুলিশের কাছে উঠে এসেছে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। কী রকম?

পুলিশ সূত্রের খবর, একদা সিপিএম ঘনিষ্ঠ বাবু সেন পরে তৃণমূলের কাছের লোক হয়ে উঠেছিল। আর তার খুনের সঙ্গে রাজ্যের এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কামারহাটির এক ‘জমি-মাফিয়া’র নামও জড়িয়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বাবু সেনের জামাইবাবু তথা গাড়ির চালক জগদীশ সরকারও ওই জমি-মাফিয়ার নাম করে অভিযোগ করেছেন। এ দিন বাবু সেনের এক ভাগ্নে পার্থ সেনও বলেন, ‘‘দিন তিনেক আগে মামা বলেছিল, ওই জমি-মাফিয়া তাকে শেষ করে দিতে পারে। তাই মামা খুব সাবধানে চলাফেরা করছিল।’’

পুলিশ এ দিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে জগদীশ ও পার্থকে জেরা করেছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, দু’জনের মুখে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য মিলেছে। জানা গিয়েছে, আততায়ীদের বাহন স্করপিওটি কামারহাটির গাড়ি। জগদীশবাবু তার ড্রাইভারকে চিনতেও পেরেছিলেন বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছেন।

এ দিন বেলঘরিয়ার বাবু সেনের দিদির বাড়ি ঠাসা ছিল আত্মীয় পরিজনের ভিড়ে। এক দিদি বাণী সেন জানান, বাবু বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটা নাগাদ টিফিন খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। দুপুরে ফোন করে জানায়, খাওয়া হয়ে গিয়েছে, ফিরতে দেরি হবে। বাণীদেবীর কথায়, ‘‘বেশ কিছু দিন ধরে সিন্ডিকেট নিয়ে বাবু মণ্ডলের সঙ্গে ভাইয়ের ঝামেলা চলছিল।
পদা বলেছিল, মিটিয়ে দেবে। তাই বলেই ও কাল ভাইকে মধ্যমগ্রামে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।’’ উল্লিখিত জমি-কারবারি বাবু মণ্ডল অবশ্য এমন কথা অস্বীকার করছেন। ‘‘আমাকে মিথ্যে ফাঁসানো হচ্ছে। বাবু সেন বলে কাউকে চিনি না। আমরা রাজনীতির লোক। আমাদের সঙ্গে ওদের কী সম্পর্ক?’’— মন্তব্য তাঁর।

কাশীপুরের বাসিন্দা জগদীশ সরকার ক’দিন আগে বাবু সেনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। চালক ছুটিতে যাওয়ায় তিনিই বাবুর গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এ দিন ওই বাড়িতে বসে জগদীশবাবু জানান, বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেলঘরিয়ার নন্দননগর ঘুরে তাঁরা বারোটা নাগাদ পৌঁছে গিয়েছিলেন মধ্যমগ্রামের রেললাইন ও খালধারের এক বাড়িতে। সেখানে বৈঠক বসে। জগদীশ বলেন, ‘‘আমি গাড়িতে ছিলাম। বেলা একটা নাগাদ ভিতর থেকে আমাকে বিরিয়ানি পাঠানো হল। মাঝে একটা বাইকে চেপে দু’টো ছেলে এসে ঘুরে যায়। আমরা সাতটা নাগাদ ওখান থেকে বার হই।’’

বৃহস্পতিবারই প্রথম নয়। আগের দিনও বাবু সেন ওই বাড়িতে গিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা ‘বৈঠক’ করে এসেছিলেন বলে জগদীশ জানিয়েছেন। সে দিনও তিনিই ছিলেন গাড়ির চালক।

এ দিকে শাসকদলের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের যোগাযোগের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘এটা সিন্ডিকেট, প্রোমোটারি নিয়ে দুই দুষ্কৃতী গোষ্ঠীর লড়াই।
এদের মধ্যে তৃণমূলের কেউ নেই।’’ কিন্তু অভিযোগের তির যাঁদের দিকে, তাঁরা যে নিজেদের তৃণমূল হিসেবে দাবি করছেন?

জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘আমি দলের জেলা সভাপতি। ওদের কেউই আমার কাছ থেকে দলের সদস্যপদ নেয়নি। কে কী দাবি করল, কী বলল, তাতে কী আসে যায়?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement