আবার একটা ছোট ঘটনা

মমতার মন্তব্যে গুরুত্ব হারাল ২ নেতার শাস্তি

শিল্পমহলের কাছে রাজ্যের ভাবমূর্তি বাঁচানোর চেষ্টা করা দূরস্থান, উল্টে জামুড়িয়ায় তৃণমূলের কিছু নেতার তোলাবাজি ও হুমকি দেওয়াকে নেহাতই ‘ছোট ঘটনা’ বলে মন্তব্য করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই ঘটনায় শ্যাম গোষ্ঠীর তরফে তিন দিন আগে থানায় লিখিত অভিযোগ করা হলেও নানা আইনি যুক্তি দেখিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি বর্ধমানের পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে তারা আরও গুটিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৩
Share:

কলকাতা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র

শিল্পমহলের কাছে রাজ্যের ভাবমূর্তি বাঁচানোর চেষ্টা করা দূরস্থান, উল্টে জামুড়িয়ায় তৃণমূলের কিছু নেতার তোলাবাজি ও হুমকি দেওয়াকে নেহাতই ‘ছোট ঘটনা’ বলে মন্তব্য করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই ঘটনায় শ্যাম গোষ্ঠীর তরফে তিন দিন আগে থানায় লিখিত অভিযোগ করা হলেও নানা আইনি যুক্তি দেখিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি বর্ধমানের পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে তারা আরও গুটিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

ওই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত দলের দুই যুব নেতা অলোক দাস ও চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুক্রবারই দলের তরফে শো-কজ করা হয়। এ দিন সেই নোটিস তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক ঘণ্টা পরেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় জানিয়েছিলেন, ওই দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে সেই শাস্তি বহাল থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। আর গোটা ঘটনাপ্রবাহে বিস্মিত এবং শঙ্কিত শিল্প মহলের বক্তব্য, এ ভাবে চলতে থাকলে আরও মলিন হবে রাজ্যের ভাবমূর্তি।

এ দিন ঠিক কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী?

Advertisement

শনিবার বিকেলে উত্তরবঙ্গ সফর সেরে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে মুখ্যমন্ত্রী জামুড়িয়া প্রসঙ্গে মুখ খুলে বলেন, “একটা ছোট ঘটনা ঘটেছে। তা-ও কথা কাটাকাটি, নাথিং এলস। কথা কাটাকাটি কোথায় হয় না?” একই সঙ্গে তাঁর দাবি, “এক তরফা অপপ্রচার হচ্ছে। কুৎসা হচ্ছে। এর সঙ্গে বাস্তব ঘটনার মিল নেই। আমি নিজে এনকোয়ারি করেছি।”

কলকাতা ফেরার আগে বাগডোগরা বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পথে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

অথচ তার আগেই এ দিন দুপুরে যুব তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্য অলোক দাস ও তৃণমূল নেতা চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি জামুড়িয়া ২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি তাপস চক্রবর্তীর বাড়িতে গিয়ে শো-কজের নোটিস ধরিয়েছেন তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি ভি শিবদাসন এবং যুব তৃণমূলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি অশোক রুদ্র। নোটিসে বলা হয়েছিল, শ্যাম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, গগন স্টিল এবং সংলগ্ন বেশ কয়েকটি কারখানায় চলা বিশৃঙ্খলায় তাঁরা জড়িত। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। অভিযুক্তদের পাঁচ দিনের মধ্যে জবাবি বক্তব্য জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও এর এক ঘণ্টার মধ্যেই মুকুলবাবু জানিয়ে দেন, “তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত দু’জনকে দল থেকে আপাতত বহিষ্কার করা হয়েছে। তা হলে তাপস ছাড় পেলেন কেন? শিবদাসনের ব্যাখ্যা, “ওঁর বিরুদ্ধে কারখানা কর্তৃপক্ষ অভিযোগ জানায়নি।”

কিন্তু বিকেলেই জামুড়িয়ার ঘটনাকে লঘু করে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “এটা মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে, ইচ্ছা করে ওয়ান সেকশন অব মিডিয়া তাদের নিজেদের স্বার্থে করছে। দেখবেন, একটা আরশোলা মরে গিয়েছে। বলতে থাকে তৃণমূল কংগ্রেস একটা আরশোলা মেরে ফেলেছে।”

অভিযুক্ত দুই যুবনেতার বিরুদ্ধে জামুড়িয়ার ইকড়া এলাকায় সিন্ডিকেট গড়ে ধারাবাহিক তোলাবাজির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু মমতা এ দিন বলে দেন, “মনে রাখবেন, আমাদের দল খুব কষ্ট করে আমরা চালাই। আমি কষ্ট করতে রাজি আছি, কিন্তু তোলা তুলে নয়। যারা তোলা তোলে, সেই তোলাবাজেরাই এই কুৎসা করে বেড়াচ্ছে।” মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে অলোক-চঞ্চলের উপর শাস্তি আর বহাল থাকবে কি? এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন মুকুলবাবু।

আর এখনও পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় পুলিশ আদৌ আর এগোবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে শিল্প মহল। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কল্লোল দত্তের কথায়, “ছোট-ছোট ঘটনাই পরে বড় ঘটনার চেহারা নেয়। এই ধরনের ঘটনায় রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ভুল বার্তা যাচ্ছে শিল্পমহলের কাছে। সরকারের উচিত সমস্যা বুঝে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।” বণিকসভা ফিকি-র পশ্চিমবঙ্গ পর্ষদের (স্টেট কাউন্সিল) চেয়ারম্যান গৌরব স্বরূপের মতে, সরকার যখন রাজ্যে নতুন বিনিয়োগ আনতে চাইছে, সেখানে এ ধরনের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গকে পিছিয়ে দেবে। সরকারের উচিত বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শিল্পগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো।

পুলিশ কিন্তু ইতিমধ্যেই শিল্পমহলের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছে। শ্যাম গোষ্ঠীর দায়ের করা অভিযোগে ঘটনার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ উল্লেখ করা হয়নি, এই যুক্তি দেখিয়ে তিন দিন কেটে গেলেও মামলা রুজু করেনি তারা। অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলা হয়নি। কেন অলোক আর চঞ্চলকে জেরা করা হল না, সেই প্রশ্ন গোড়া থেকেই এড়িয়ে চলছিলেন শিল্পাঞ্চলের পুলিশকর্তারা। এ দিনও আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল বলেন, “যা বলার, এডিসিপি (সেন্ট্রাল) বলবেন।” এডিসিপি (সেন্ট্রাল) বিশ্বজিৎ ঘোষ আবার বলেন, “এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারব না।” তবে সন্ধ্যায় এক পুলিশকর্তা সোজাসুজি বলে দেন, “ব্যাপারটা অনেক উপরে চলে গিয়েছে। আমাদের স্তরে এ নিয়ে আর কিছু বলা যাবে না।” যদিও পুলিশ এর পর কোনও ব্যবস্থা নেবে কি না জানতে চাওয়া হলে মুকুলবাবুর জবাব, “পুলিশ কী করবে, সেটা নিয়ে দল কী বলবে?”

পুলিশের কাজে অগ্রগতি বলতে, এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ জামুড়িয়া থানার এসআই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানায় গিয়ে কর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। সংস্থার অন্যতম অধিকর্তা সুমিত চক্রবর্তীর কথায়, “এসআই আমাদের কাছে এসে জানতে চান, কবে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে, কোন-কোন দিন অবাঞ্ছিত ভাবে কারখানা চত্বরে ঢুকে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা হয়, কবে-কবে বিক্ষোভের নামে কাজ বন্ধ করা হয়েছে। তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বও আমাদের কাছে এসেছিলেন। পুলিশকে যা বলেছি, ওঁদেরও তাই বলেছি।”

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছেন বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। এ দিন আসানসোলে গিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি জানতে চান, “কারখানা কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট নাম দিয়ে অভিযোগ করার পরেও পুলিশ কোনও মামলা বা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?” আজ, রবিবার তাঁর জামুড়িয়ায় যাওয়ার কথা। আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের আক্ষেপ, “হলদিয়ায় এবিজি-কে তাড়ানো দিয়ে শুরু হয়েছে শিল্পের উপর তৃণমূলের হামলা। দেশের শিল্প মহলে বাংলার সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে।”

মমতার মন্তব্য নিয়ে কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “এক জন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে নিজে তদন্ত করা সম্ভব নয়। উনি তো ঘটনাস্থলে যাননি। তাঁকে পুলিশ-প্রশাসনের উপর নির্ভর করতে হবে। আর ওঁর পুলিশ তো ওঁর মনের মতো করেই রিপোর্ট দেবে!” সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেন, “আমরা জানতে চাই, কোন পর্যায়ে এই তদন্ত হয়েছে?”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement