ধৃত: তুরিয়া ওরাওঁ। নিজস্ব চিত্র।
একটানা আন্দোলনে শুধু দার্জিলিঙের জনজীবনই বিপর্যস্ত নয়। সমতলও নাজেহাল। জেরবার প্রশাসন। আর এই সমূহ সর্বনাশের আবহে পৌষ মাস চোরাকারবারিদের। আন্দোলনের ডামাডোলকে কাজে লাগিয়ে পাহাড় আর ডুয়ার্সের গাছ কেটে সাফ করে দিচ্ছে তাদের সংগঠিত চক্র।
রবিবার মংপং চেকপোস্টের কাছ থেকে চোরাই কাঠ-সহ গ্রেফতার করা হয়েছে তুরিয়া ওরাওঁ নামে বাগরাকোটের কাঠ পাচার চক্রের এক চাঁইকে। মাসখানেকের মধ্যে এই নিয়ে জনা পঁচিশ পাচারকারী ধরা পড়ল। বন দফতর সূত্রের খবর, এর আগে ধৃতদের জেরা করে এই কাঠ পাচার চক্রের সঙ্গে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার একাংশের যোগসাজশের খবর পাওয়া গিয়েছিল। এ বার তুরিয়াকে জেরা করে যে-তথ্য মিলেছে, তাতে মোর্চার কয়েক জন নেতার কথা নির্দিষ্ট ভাবে উঠে এসেছে।
পুলিশ ও বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মোর্চা-ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু যুবক পর্যটন বা পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বন্ধ ঘোষণা হতেই তারা বাড়ি ফিরে যেতে চাইছিল। দলবদ্ধ ভাবে ফিরে যাওয়ার ধুম দেখেই পুলিশ ও বন দফতরের একাংশের সন্দেহ হয়। সোর্স মারফত খবর নিতেই তাঁরা জানতে পারেন, আন্দোলন ও বন্ধের সুযোগে প্রশাসনের নজরদারি আলগা হতেই কাঠ পাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই সূত্র কাজে লাগিয়েই জাল বিছানো হয়েছিল। বন দফতরের এক অফিসার জানান, বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে রাতারাতি গাছ কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। তার পরে সেই কাঠ চলে যাচ্ছে বিভিন্ন কাঠ চেরাই কলে। পাহাড়ের কিছু কিছু এলাকায় রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে আসবাবের কারখানা। চোরাই কাঠ থেকে আসবাব এবং জানলা-দরজার ফ্রেম তৈরি করেও পাচার করা হচ্ছে বলে তদন্তকারীদের একাংশের দাবি।
বন দফতরের এক পদস্থ অফিসার জানান, উত্তরবঙ্গের বেলাকোবা রেঞ্জে গত এক মাসে ১০টি কাঠবোঝাই গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কাটা হচ্ছে মূলত শাল, সেগুন, চিরুনি এবং ধুপিগাছ। বাজেয়াপ্ত করা কাঠের দাম অন্তত ২০ লক্ষ টাকা। আরও অনেক গাছ কেটে পাহাড় ও ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গাড়ি চাপিয়ে এবং নদীতে ভাসিয়ে প্রচুর কাঠ পাচার হয়ে গিয়েছে। এই চক্রে জড়িত হিসেবে শিলিগুড়ি, বাগরাকোটের কিছু কাঠ ব্যবসায়ীর নামও উঠে এসেছে। বন দফতরের রেঞ্জার সঞ্জয় দত্তের নেতৃত্বে একটি বিশেষ দলকে এই কাঠ পাচারের তদন্তে নামানো হয়েছে।
বন দফতর জানাচ্ছে, কালিম্পঙে নেওড়া ভ্যালি সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সিপচু, চাপড়ামারি, মহানন্দা অভয়ারণ্যের একাংশের গাছও সাফ করে দিয়েছে চোরাকারবারিরা। বন দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘মাসখানেকের মধ্যে পাহাড় ও ডুয়ার্সের অরণ্যের যে-ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে বহু বছর লেগে যাবে। নির্বিচার বৃক্ষ নিধনের জেরে দার্জিলিং-সহ উত্তরবঙ্গের সামগ্রিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’’
কী ভাবে নজর এড়িয়ে কাঠ পাচার হয়ে গেল, প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। কাঠ চেরাই কল এবং কাঠ ব্যবসায়ীদের উপরে বন দফতর যথাযথ ভাবে নজরদারি চালায় না কেন, উঠছে সেই প্রশ্নও। প্রশাসনের একাংশের অভিযোগ, ওই কাঠ পাচার চক্রের সঙ্গে পুলিশ এবং বন দফতরের কিছু অফিসারেরও ঘনিষ্ঠতা আছে। সেই ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগাচ্ছে চোরাকারবারিরা। ‘‘তদন্তে যদি প্রশাসনের কারও গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে তাঁকেও রেয়াত করা হবে না,’’ বলছেন বন দফতরের এক শীর্ষ কর্তা।