—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ইচ্ছেপূরণ হলে দক্ষিণ ভারতের তিরুপতি মন্দিরে ভক্তরা চুল দান করেন। টন টন সেই চুল বিক্রি করে বছরে অন্তত দেড়শো কোটি টাকা আয় করেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। এই খবর শুনেছেন অনেকেই। এ রাজ্যেও যে চুল বিক্রির কোটি টাকার কারবার চলে এবং সে কারবারের সঙ্গে যোগ রয়েছে বীরভূমের তা প্রকাশ্যে এল বিশ্বভারতীয় বিদেশি পড়ুয়াকে ‘অপহরণের’ পর।
মায়ানমারের বাসিন্দা ওই পড়ুয়া নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে অপহরণের অভিযোগ করেছিলেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। পুলিশি তদন্তে নেমে উঠে আসে, চুলের কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওই গবেষক ছাত্র। বিদেশ থেকে পড়তে এলেও তাঁর কাছে ছিল ভারতের প্যান কার্ড! এমনকি তাঁকে অপহরণের অভিযোগে ধৃতেরা দাবি করে, ওই ছাত্র ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে ফয়সালা করতে নিজেই তাঁদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে, ওই ঘটনার পরে জেলায় বেআইনি চুলের কারবার নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার নানুর, দুবরাজপুর, ইলামবাজার-সহ নানা এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক বাসিন্দা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে চুলের কারবারে জড়িয়ে আছেন। চুলের কারবার চলে পড়শি মুর্শিদাবাদ ও মেদিনীপুরেও। বিভিন্ন সেলুন, বিউটি পার্লার ও বাড়ি বাড়ি থেকে সংগৃহীত চুল পরিচ্ছন্ন এবং সোজা করে প্যাকেটজাত করা হয়। দৈর্ঘ্য অনুযায়ী এক কিলো চুলের দাম ঘোরাফেরা করে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। বেশ কয়েক হাত ঘুরে বিদেশে পৌঁছয় সেই চুল। তার মধ্যেই কিলো প্রতি চুলের দাম বেড়ে যায় তিন চার হাজার টাকা। সেই চুল থেকেই প্রযুক্তির সাহায্যে মূলত পরচুলা বা খেলনা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
এই চুল-চক্রে বীরভূমের কী ভূমিকা? পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রাথমিক ভাবে বীরভূমের কাজ চুলের জোগান দেওয়া। বিভিন্ন ‘কাঁটা’-ই চুল সংগ্রহের প্রাথমিক উৎস। কাঁটা অর্থাৎ সেখানে পুরনো টিন, লোহা, গাড়ি-র ব্যাটারি, প্লাস্টিক, পুরনো পোশাক, ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়ামের বাসন ইত্যাদির কেনাবেচা চলে। সঙ্গে কেনাবেচা চলে চুলেরও। জেলা জুড়ে প্রচুর সংখ্যায় ফেরিওয়ালা এই কারবারে যুক্ত। দিনভর গ্রাম গ্রামে ঘুরে অন্য জিনিস সংগ্রহ করার সঙ্গে তাঁরা মহিলাদের চুলও সংগ্রহ করেন।
আঁচড়ানোর সময় ঝরে যাওয়া চুল জমিয়ে রাখেন গ্রামের হাজার হাজার মহিলা। সামান্য একটা প্লাস্টিকের খেলনা বা টিপ বা চুড়ির পরিবর্তে জমিয়ে রাখা সেই চুল ফেরিওয়ালাদের দিয়ে দেন তাঁরা। জেলার বেশ কয়েকজন কারবারির সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, দিনের শেষে এক একজন ফেরিওয়ালা অন্য ভাঙাচোরা জিনিসের পাশাপাশি নিয়ে আসেন যত্নে সংগ্রহ করা ৫০ থেকে ১৫০ গ্রাম চুলও। কারণ ১৮ ইঞ্চি মাপের ১০০ গ্রাম চুলের দাম গড়ে ৪৪০ থেকে ৪৬০ টাকা। দৈর্ঘ্য কম হলে দাম কমে। ডাই করা বা পাকা চুলের দর অবশ্য অনেক কম।
সেই চুল কাঁটা থেকে প্রায় ৫ হাজার টাকা কিলো দরে কিনে নেন চুলের কারবারিরা। জানা গিয়েছে, বিশ্বভারতীর বিদেশি ছাত্রের অপহরণের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া দুবরাজপুরের এক বাসিন্দা তেমনই এক চুলের কারবারি। এমন কারবারি জেলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের কাজ সেই চুল মহাজনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া।
এ ছাড়াও জেলার বিভিন্ন বিউটি পার্লার চুল সংগ্রহের অন্যতম জায়গা। দুবরাজপুরে বিউটি পার্লার চালান এমন এক মহিলা জানিয়েছেন, চুলের কারবারিরা এসে চুল সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। যত লম্বা চুল দাম তত বেশি। কমপক্ষে ছয় থেকে আট ইঞ্চির মতো ছোট চুল ও আরও বড় চুল মিলিয়ে বছরে কম পক্ষে দু-আড়াই কিলো চুল বিক্রি হয়ে থাকে।
চুল সংগ্রহের পর নিয়ে আসা হয় ‘কাঁটা’য়। সেখানে চুলের মান যাচাই হয়। জেলায় কাঁটা চালান, এমন এক কারবারি বলছেন, ‘‘আমাদের কাজ শুধু যারা চুল কেনে তাদের হাতে চুল তুলে দিয়ে টাকা কামানো। তবে সংগৃহীত চুলের মান কেমন, সেটা যাচাই করে নিতে হয়।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চুলের কারবারি বলছেন, ‘‘সংগৃহীত চুল নদিয়ার বেলডাঙা ও মেদিনীপুরের নন্দকুমার থানা এলাকায় বড় মহাজনদের কাছে পৌঁছয়। এলাকার স্থানীয় মহিলারা সেই চুল সংগ্রহ করে সেগুলিকে পরিচ্ছন্ন করে এবং যন্ত্রের মাধ্যমে সোজা করে মাপ অনুযায়ী ফের মহাজনের কাছে পৌঁছে দেন।’’
বীরভূমের আর এর কারবারির কথায়, ‘‘আমাদের জেলায় এই কাজ হয় না। সেই চুল মায়ানমার, চিন-সহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে। সেটা কীভাবে জানা নেই। লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার চলে এভাবেই।’’ মায়ানমারের ছাত্রের তাই এই চক্রে কোনও ভূমিকা ছিল কি না তা নিয়ে জল্পনা দানা বেঁধেছে। পুলিশ সূত্রে খবর, সমস্ত দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।