অনেক দিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিল নারকোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)। নজর রাখা হচ্ছিল মালদহের বৈষ্ণবনগরের বেদরাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য সুবোধ প্রামাণিক ও তাঁর সঙ্গীদের উপরে। এক-দু’দিন নয়, নজরদারি চলছিল এক মাস ধরে। বুধবার কাকভোরে সুবোধবাবুকে আফিম সমেত পাকড়াও করল এনসিবি। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি অন্যতম সদস্য।
এনসিবি জানাচ্ছে, কয়েক বছর ধরেই মালদহে বেআইনি আফিম চাষ হচ্ছে। তার সঙ্গে নাম জড়িয়েছে শাসক দলের নেতাদের। এই ব্যবসা থেকে সহজেই কাঁচা টাকা পাওয়া যায়। ফলে, বহু মানুষকে তা আকর্ষণ করছে বলে এনসিবি সূত্রের খবর। সূত্রটির অভিযোগ, লাভের আশায় এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন শাসক দলের ছোট ও মাঝারি মাপের বহু নেতাই। সুবোধবাবু এই বেআইনি আফিম চাষ চক্রের অন্যতম পাণ্ডা বলে দাবি করেছে এনসিবি।
জেলা তৃণমূল সূত্র জানাচ্ছে, সুবোধবাবু আগে সিপিএম করতেন। সিপিএমের পঞ্চায়েত সদস্যও ছিলেন। বছরখানের আগে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি কালিয়াচক তিন নম্বর ব্লক তৃণমূলের সহ-সভাপতি। মালদহ জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন অবশ্য বলেছেন, ‘‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব।’’ সুবোধবাবুকে গ্রেফতার করা হলে স্থানীয় স্তরে তৃণমূল নেতা, কর্মীরা বাধা দিতে পারেন তা আঁচ করে মঙ্গলবার রাত একটা নাগাদ সুবোধবাবুর সফদলপুরের সুবোধবাবুর বাড়িতে হানা দেন এনসিবি অফিসারেরা। ভোর সাড়ে চারটের সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করে মালদহ শহরের একটি হোটেলে নিয়ে আসা হয়। এনসিবি-র অভিযোগ সুবোধবাবুর বাড়ির ছাদ থেকে পৌনে তিন কিলোগ্রাম ওজনের আফিমের তাল পাওয়া গিয়েছে।
এদিন ভোর হতেই সুবধবাবুর গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই। এনসিবি মালদহ শহরে যে হোটেলে সুবোধবাবুকে রেখেছিল তার সামনে তৃণমূলের কর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেন। সুবোধবাবুকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। যে ভাবে ওই তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতাপ করা হয়েছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে এনসিবি-র বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। পুলিশ সূত্রের অভিযোগ, এনসিবি অফিসারদের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার জন্যও পুলিশের উপরে চাপ সৃষ্টি করা হয়। এ দিন দুপুরে মালদহ আদালতে তোলা হয় সুবোধবাবুকে। তাঁকে ১০ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
এনসিবি সূত্রে বলা হয়, কোনও ব্যক্তির কাছে আড়াই কিলোগ্রামের বেশি আফিম পেলে তা বাণিজ্যিক কারণে রাখা হয়েছে বলে মনে করা হয়। সে ক্ষেত্রে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করা যায় এবং অভিযুক্তের প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত সাজার সম্ভাবনা থেকে যায়। সুবোধবাবুর বিরুদ্ধে সেই ধারাতেই অভিযোগ দায়ের করা হয়। ধৃত তৃণমূল নেতার সঙ্গে আর কারা জড়িত তা জানার চেষ্টা করছে এনসিবি। সুবোধবাবুকে জেরা করতে কলকাতা থেকে মালদহে গিয়েছেন খবর পেয়ে এনসিবি-র পূর্বাঞ্চলের অধিকর্তা দিলীপ শ্রীবাস্তব।
এনসিবি-র প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, শুধু সুবোধবাবু নয়, এই আফিম চাষ ও তা থেকে হেরোইন পাউডার বানানোর সঙ্গে স্থানীয় আরও বেশ কিছু লোক জড়িত। অভিযোগ, এঁরা সকলেই সুবোধবাবুর অধীনে কাজ করতেন। মঙ্গলবার রাতে সুবোধবাবুর প্রতিবেশি এক ব্যক্তির বাড়িতেও হানা দিয়েছিল এনসিবি। তাঁর বাড়ি থেকে আফিম মা মিললেও, পাওয়া গিয়েছে ৯টি তাজা বোমা ও একটি গুলি। সুবোধবাবু বহুদিন ধরেই আফিম চাষ ও হেরোইন বিক্রি চক্কর সঙ্গে জড়িত বলে মনে করছেন এনসিবি অফিসারেরা। এক তদন্তকারী অফিসারের মন্তব্য, ‘‘সেই জন্যই দল পরিবর্তন করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন ওঅ ব্যক্তি। তাঁর কাছ থেকে যে আফিম পাওয়া গিয়েছে তার বাজার দর দেড় থেকে দু’লক্ষ টাকা।’’
এনসিবি জানাচ্ছে, এ দেশে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ ছাড়া অন্য কোথাও আফিম চাষের অনুমতি দেয় না কেন্দ্রীয় সরকার। অর্থাৎ দেশের অন্য যেখানে এই চাষ হয় তা পুরোটাই বেআইনি। পশ্চিমবঙ্গে মূলত মালদহ জেলাতেই বেআইনি আফিমের চাষ বেশি হয়। আফিমের থেকে তৈরি হয় হেরোইন। এক সময়ে উত্তরপ্রদেশের বারাবাঙ্কিতে আফিম থেকে হেরোইন বানানোর কাজ হতো। মালদহের আফিম আগে সেখানেই পাচার হতো। এনসিবি জানাচ্ছে, গত ৫-৬ বছর ধরে মালদহেই হেরোইন তৈরির অনেক ‘ঠেক’ গড়ে উঠেছে। প্রতি কিলোগ্রাম আফিমের বাজারদর যেখানে ৬০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা, হেরোইনের বাজারদর তার দশ গুণ।