বোতলের জল কতটা নিরাপদ, উঠছে প্রশ্ন

আইন রয়েছে। তা প্রয়োগের জন্য জেলা ও রাজ্য স্তরে রয়েছেন প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু সে সবের কোনও তোয়াক্কা না করেই নদিয়া জেলার সর্বত্রই রমরমিয়ে চলছে মাটির নীচের জল তুলে পানীয় জলের বোতল তৈরির কারখানা। তাতে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই স্বাস্থ্যে ক্ষতির আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। এই কারখানার কয়েকটিতে ঘুরে দেখা যাচ্ছে, স্রেফ ক্লোরিন মিশিয়ে মাটির নীচের জল ভরে দেওয়া হচ্ছে বোতলে।

Advertisement

মনিরুল শেখ

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৫ ০১:৫৭
Share:

আইন রয়েছে। তা প্রয়োগের জন্য জেলা ও রাজ্য স্তরে রয়েছেন প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু সে সবের কোনও তোয়াক্কা না করেই নদিয়া জেলার সর্বত্রই রমরমিয়ে চলছে মাটির নীচের জল তুলে পানীয় জলের বোতল তৈরির কারখানা। তাতে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই স্বাস্থ্যে ক্ষতির আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। এই কারখানার কয়েকটিতে ঘুরে দেখা যাচ্ছে, স্রেফ ক্লোরিন মিশিয়ে মাটির নীচের জল ভরে দেওয়া হচ্ছে বোতলে। আর্সেনিক, ফ্লোরাইডের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে কিনা, তা পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থাই নেই অধিকাংশ পানীয় জলের কারখানায়। নিয়ম অনুসারে যে সব সরকারি নজরদারি করার কথা, তা-ও করা হচ্ছে না।
জেলা প্রশাসনের রিপোর্টই বলছে, জেলার ১৭টি ব্লকই আর্সেনিকপ্রবণ। অতএব, জেলার কোনও অংশ থেকেই ব্যবসায়িক কারণেই জল তোলা যাবে না। কিন্তু সে নির্দেশের তোয়াক্কা না করে মাটির নীচের জল তুলে, তা ‘পরিস্রুত’ করে ২০ লিটারের জার বন্দি করে বিক্রি হচ্ছে। সীমান্ত শহর করিমপুর থেকে জেলা সদর কৃষ্ণনগর, সব জায়গাতেই অনুমতি ছাড়াই গজিয়ে উঠেছে অন্তত শ’তিনেক পানীয় জলের বোতল তৈরির কারখানা। নাকাশিপাড়ার নীচু বাজার এলাকার জল ব্যবসায়ী কালু বৈদ্য জানান, ১৪০ ফুট মাটির তলা থেকে জল তুলে তা শোধন করে বাজারজাত করা হয়। কিন্তু সেই জলে আর্সেনিকের মত বিষাক্ত কোনও পদার্থের উপস্থিতি কীভাবে যাচাই করা হয়? কালুবাবু বলেন, ‘‘সে সব কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে বছর দু’য়েক আগে একবার ব্লক অফিসে জলের নমুনা পরীক্ষা করিয়েছিলাম।’’

Advertisement

জে‌লা প্রশাসন সূত্রে‌র খবর, জেলায় মাত্র ছ’টি সংস্থা প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে জলের ব্যবসা করে। তাছাড়া আরও পনেরোটি সংস্থা রয়েছে যারা নিজেদের প্রকল্পে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারের জন্য অনুমতি নিয়েছে। এ সবের বিরুদ্ধে প্রশাসন কী পদক্ষেপ করছে? জেলার জলসম্পদ অনুসন্ধান দফতরের ভূতত্ত্ববিদ বিনয় মাহাতো বলেন, ‘‘আমরা ইতিমধ্যে কৃষ্ণনগর-১ ব্লকের ১০টি প্রকল্প বন্ধ করার জন্য নোটিস জারি করেছি। কিন্তু সেগুলি বন্ধ করার কথা পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের।’’ কিন্তু শ’তিনেক বেআইনি জলপ্রকল্পের মধ্যে মাত্র দশটিকে নোটিস ধরালেই কী কাজ শেষ? সে প্রশ্নের অবশ্য কোনও জবাব মেলেনি। নদিয়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতী অবশ্য বলছেন, ‘‘বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। এ ব্যাপারে‌ জল সম্পদ অনুসন্ধান দফতরের একটি মিটিং ডাকা হয়েছে। দিন পনেরোর মধ্যে সমস্ত বেআইনি পানীয় জল তৈরির কারখানায় তালা লাগানো হবে।’’

জেলা জল সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন দফতরের এক আধিকারিক অবশ্য স্পষ্টই বলছেন, বেআইনি জল প্রকল্পের কাজকর্ম বন্ধ করতে কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এক কারখানার মালিক জানালেন, তিনি দিনে ২০ লিটার জারের এক হাজার জার তৈরি করেন। অর্থাৎ এক এক দিনে কমবেশি ২০ হাজার লিটার জল তুলছে এক একটি কারখানা। শ’তিনেক কারখানা নিয়মিত এই হারে জল তুললে তার ফল কী হতে পারে, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়।

Advertisement

ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ বোঝার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র সেচ দফতরের তরফে রাজ্যে একাধিক সমীক্ষা হয়েছে। প্রতিটিতেই ধরা পড়েছে, জলস্তর কমায় মাটির গভীরে থাকা আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডের মত বিষাক্ত পদার্থের স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে জলস্তর। এই সঙ্কট মোকাবিলার জন্যই ‘ওয়েস্ট গ্রাউন্ড ওয়াটার রিসোর্সেস (ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল অ্যান্ড রেগুলেশন অ্যাক্ট ২০০৫) পাশ হয়। ওই বছরেরই ৩১ অগস্ট থেকে আইন কার্যকরী হয়। আইনে বলা রয়েছে, বিনা অনুমতিতে মাটির তলার জল ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অনুমতি পেতে গেলে নানা শর্ত মানতে হবে। যেমন, কারখানায় থাকতে হবে জলাশয়, যাতে বৃষ্টির জল মাটির নীচে গিয়ে জলস্তর ফের উঠতে পারে।

কিন্তু সে নিয়ম মানছে কে? দিনকয়েক আগে ধুবুলিয়া থানা এলাকার একটি জল প্রকল্পের কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, স্রেফ মেশিন চালিয়ে জল তোলা হচ্ছে। নিয়ম অনুসারে সেখানে ৭ হাজার বর্গফুট জলাশয় থাকার কথা। কোনও জলাশয় কোথাও নেই। এই ছবি অধিকাংশ পানীয় জল কারখানায়, বলছেন জলসম্পদ বিভাগের কর্তারা।

শুধু তাই নয়, জল শুদ্ধ হল কিনা, তার পরীক্ষাগারও নেই ওই কারখানায়। নিয়ম অনুযায়ী, ছ’মাস অন্তর সরকারি কোনও পরীক্ষাগার থেকে বেসরকারি পানীয় জল তৈরির কারখানার জলের নমুনাও পরীক্ষা করার কথা। তা-ও যে হয় না, তা জানালেন কারখানার কর্মীরা। শুধু ধুবুলিয়া নয়, এ ভাবেই নাকাশিপাড়া, কালীগঞ্জ, রানাঘাট, কল্যাণী, তেহট্ট, কৃষ্ণনগর পুরসভা এলাকা সব জায়গাতেই চলছে বোতলে পানীয় জল ভরার কারখানা।

প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, এই সব জলের চাইতে নলকূপের জল বেশি নিরাপদ। আর্সেনিক-কবলিত নদিয়ায় বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য রয়েছে গঙ্গার জলপ্রকল্প। জেলার বেলপুকুর, কাশিয়াডাঙা ও ভাগ্যবন্তপুর-এই তিনটি প্রকল্প এলাকায় গঙ্গার জলকে শোধন করে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু রংচঙে প্যাকেজের মোহে পড়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন এখন আর গঙ্গার জল পান করেন না।

জেলা জলসম্পদ অনুসন্ধান দফতরের আশঙ্কা, পানীয় জল কারখানাগুলি রয়েছে আর্সেনিক কবলিত এলাকাতেও। সেখানকার জল শরীরের পক্ষে রীতিমতো ক্ষতিকর। সেই জলের নমুনা পরীক্ষাও ঠিক মতো হয় না। ফলে বিশুদ্ধ পানীয় জল খাওয়ার উদ্দেশে যে জল মানুষ খাচ্ছেন, তা আদৌ আর্সেনিকমুক্ত, নিরাপদ কিনা, সে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement