নবান্ন সভাঘরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নন্দিনী চক্রবর্তী। — নিজস্ব চিত্র।
রাজ্যপালের ‘অপছন্দের’ কারণে রাজভবনের প্রধান সচিবের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়েছিল আইএএস নন্দিনী চক্রবর্তীকে। প্রথম কয়েকটা দিন নবান্ন তা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করলেও পরে নন্দিনীকে পাঠানো হয় পর্যটন দফতরে। রাজভবনের ‘রোষে’ পড়ার পর থেকে নন্দিনীকে সে ভাবে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। অবশেষে দেখা গেল বুধবার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নবান্নের সভাঘরে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রমোশন বোর্ড’-এর বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নন্দিনী। ছিলেন আরও অনেকেই। কিন্তু তাঁকে আলাদা করে দেখা গেল। কারণ, সম্প্রতি বার্লিন থেকে বাংলার পর্যটন দফতরের তরফে নিয়ে আসা পুরস্কারটি নন্দিনী সটান তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রীরই হাতে।
নন্দিনীর দফতর বদল নিয়ে কম নাটকীয়তা হয়নি। ১৯৯৪ ব্যাচের আইএএস অফিসার নন্দিনী অতীতে রাজ্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ দফতরের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমেও। জগদীপ ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি হয়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পর তিনি রাজভবনের প্রধান সচিব হন। কিন্তু শোনা যাচ্ছিল, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতের মিল হচ্ছে না। রাজ্য বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি ‘তৃণমূল-ঘনিষ্ঠতার’ অভিযোগও তোলে। এর পরে জানা যায়, রাজ্যপাল নন্দিনীকে সরিয়ে দিতে চেয়ে নবান্নকে বার্তা পাঠিয়েছেন। নবান্ন প্রথমে তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। এমনকি, রাজভবন থেকে নন্দিনীকে সরাতে বলে রাজ্য প্রশাসনের কোনও বার্তা আসার কথাও প্রথমে মানতে চাওয়া হয়নি। রাজভবনের খবর জানাজানি হওয়ার তিন দিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি নন্দিনীকে পাঠানো হয় পর্যটন দফতরে। যে দফতরের মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়।
নন্দিনীর পরে এখনও নতুন প্রধান সচিব পায়নি রাজভবন। কিন্তু এরই মধ্যে বার্লিন থেকে পর্যটন দফতরের হয়ে একটি পুরস্কার নিয়ে এসেছেন নন্দিনী। গত ৯ মার্চ বার্লিনে ‘ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অ্যান্ড অ্যাভিয়েশন লিডার্স অ্যাসোসিয়েশন’ একটি অনুষ্ঠানে বাংলাকে ‘বেস্ট ডেস্টিনেশন ফর কালচার’ পুরস্কার দেয়। বুধবার নবান্ন সভাঘরে বৈঠকের মাঝেই সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির গৌরবের কথা উল্লেখ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তিনিই ডেকে নেন নন্দিনীকে। আর নন্দিনী ওই পুরস্কার সম্পর্কে বলতে বলতেই ইচ্ছাপ্রকাশ করেন যে, বার্লিন থেকে পাওয়া স্মারকটি তিনি মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে চান। রাজি হয়ে যান মমতাও। বলেন, ‘‘ঠিক আছে। ওই স্মারক মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে রাখা থাকবে।’’ তার পরেই নন্দিনী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এসে স্মারকটি তাঁর হাতে তুলে দেন। সেখানে অবশ্য তখন ছিলেন মন্ত্রী বাবুলও।
রাজ্যের অনেক দায়িত্ব পালন করলেও অতীতে নন্দিনীর সঙ্গে মমতার দূরত্ব তৈরি হওয়ার কথাও প্রশাসনের অন্দরে শোনা যায়। যদিও সে বিষয়ে কেউই প্রকাশ্যে কখনও কিছু বলেননি। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর নন্দিনী মমতার ‘প্রিয় পাত্রী’ হয়ে ওঠেন বলে আধিকারিকদের একাংশের দাবি। তখন রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও তথ্যসংস্কৃতি দফতরের সচিবের মতো গুরুদায়িত্ব একসঙ্গে সামলেছেন নন্দিনী। পরে প্রশাসনে তাঁর গুরুত্ব কমতে থাকে বলে একটি প্রশাসনিক সূত্রের দাবি। কিন্তু প্রকাশ্যে তার কোনও প্রতিফলন দেখা যায়নি।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, প্রথমে নন্দিনীকে নিগম থেকে সরানো হয়। পরে তথ্যসংস্কৃতি দফতর থেকে তাঁকে পাঠানো হয় স্টেট গেজেটিয়ারের ‘এডিটর’ পদে। সেখান থেকে সুন্দরবন উন্নয়ন। তার পর ফের প্রশাসনিক দিক থেকে প্রায় ‘গুরুত্বহীন’ বলে পরিচিত প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে। সেই নন্দিনী রাজভবনে যাওয়ার পরে বিরোধী দলের থেকে ‘শাসকদলের লোক’ তকমা পেয়েছিলেন। রাজভবন সূত্রে যা জানা যায়, তাতে সেই তকমার কারণেই তাঁকে সরতে হয়েছে। বুধবার নবান্ন সভাঘরে সর্বসমক্ষে নন্দিনীকে কাছে ডেকে নিয়ে কি কোনও ‘বার্তা’ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা? তিনি কি বুঝিয়ে দিলেন, নন্দিনীর উপরে তাঁর আস্থা এবং ভরসা অটুট? প্রশাসনিক মহলের অনেকে অবশ্য বলছেন, নন্দিনীকে বার্লিনে পাঠিয়ে সেই বার্তা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন মমতা। এ বার তা প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন।