শত অনুরোধেও বলতে চাইলেন না শুক্রবার বিকেলে কোথায় ছিলেন। বিধানসভায় শিলিগুড়ির তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পর ভাইচুং ভুটিয়ার প্রথম প্রতিক্রিয়া, ‘‘আরে আমি নিজেই তো অবাক!’’
সেকেন্ড পাঁচেক চুপ থেকে ভাইচুং বললেন, ‘‘দিন দু’য়েক আগে একটা কানাঘুষো শুনছিলাম, দল প্রার্থী করতে পারে। কিন্তু কনফার্মড ছিলাম না। তাই এ দিন খবরটা শুনে কিছুটা হলেও সারপ্রাইজড।’’
তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তা হলে টিকিটের জন্য দরবার করেননি? প্রশ্ন শুনে ভর সন্ধেয় প্রায় আর্তনাদ করে বসলেন ভাইচুং। ‘‘লোকসভা ভোটের পর পার্টিকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে দলের হয়ে মানুষের জন্য কাজ করব। কখনই নেত্রীর কাছে গিয়ে টিকিটের জন্য দরবার করিনি। কিন্তু আমাকে যে ফের সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাঁর জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করব।’’
গত লোকসভা ভোটে দার্জিলিং থেকে লড়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে। কিন্তু বিজেপির কাছে হেরে যান ভাইচুং। আর এ বার তো একদম বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘ শিকারের মতো চ্যালেঞ্জ! যে আসনে লড়ছেন ভারতীয় ফুটবলের ‘পাহাড়ি বিছে’, সেই শিলিগুড়িতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার কথা অশোক ভট্টাচার্যের। জেলা পরিষদের ভোটে যাঁর ‘শিলিগুড়ি মডেল’ (তৃণমূল বিরোধী অসাম্প্রদায়িক জোট)-এর সাফল্য বামশক্তির লাইট হাউস ফের বাংলার মসনদ দখল করতে। সেই ফর্মুলাতেই বাম-কংগ্রেস আসন ভাগাভাগির রাজনৈতিক সম্ভাবনা বঙ্গ-রাজনীতির আকাশে উঁকি মারছে। সেই ধুরন্ধর রাজনৈতিক মস্তিষ্ক অশোক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে লড়াইটা কতটা শক্ত? শুনে হাসছেন ভাইচুং। ফুটবলার জীবনে অনেক বাঘা বাঘা ডিফেন্ডারের রাতের ঘুম কেড়েছেন। এ বার পলিটিক্সের বড় ম্যাচ খেলতে নামার আগে তাঁর উত্তর, ‘‘ভারত বা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের বিরুদ্ধে যখন জাপান, অস্ট্রেলিয়ার টিমের বিরুদ্ধে খেলতে নামতাম, তখন তো জানতামই ওদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শক্ত। কিন্তু কোচরা বলতেন, তোমাকে তো মাঠে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওরা গোল করবে না। তুমিও চেষ্টা করে দেখ না। এ কথাটাই মাথায় ঘুরছে।’’
একটু থেমে ফের বললেন, ‘‘ফুটবলাররা মাঠে জান লড়িয়ে দিলে গোল পান। আর ভোটের লড়াই জিততে গেলে জনতা জনার্দনের উপর নির্ভর করতে হয়। কাজেই গত বারের মতো এ বারও মানুষের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করব। জানতে চাইব ওদের দুঃখ, অভাবের কথা।’’
কী বলবেন? এ বার হঠাৎ সাবধানী ভাইচুং। ‘‘জিতলে এই করে দেব, ওই করে দেব মার্কা প্রতিশ্রুতি দেব না। কারণ আমার কেন্দ্রে এক এক জায়গায় এক রকম সমস্যা। কসমোপলিটন, কমার্শিয়াল সিটি শিলিগুড়ির উন্নতিতে প্রচুর কাজ করার আছে। তৃণমূল স্তর থেকে সমাজের জন্য সেই কাজগুলো করতে চাই।’’
কিন্তু মেগা প্রার্থী অশোক ভট্টাচার্য? এ বার তাঁর সেই ডাইরেক্ট ফুটবলের মতোই ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি গোল করা ভাইচুং বলছেন, ‘‘অশোকদা আমার দাদার মতো। আমাদের দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল, আছে, থাকবে। আর রাজনীতিতে তো উনি একটা বিশাল ব্যাপার। সুনীল ছেত্রী, রেনেডি সিংহের মতো বন্ধুদের বিরুদ্ধে খেলার সময় যে রকম অনুভূতি হত, এখানেও ঠিক সে রকম হচ্ছে।’’ সঙ্গে এটাও বলে দিলেন, ‘‘এটা রাজনীতির লড়াই। আমার দলের কর্মীদের বলব, নীতি নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু কেউ যেন অশোকদাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করেন।’’
পাহাড়ে ইতিউতি ঘাসফুল উঁকি দিলেও লোকসভায় মোর্চার দুর্গে ঘাস ফোটাতে পারেনি তৃণমূল। তাই মোর্চার জোটসঙ্গী বিজেপি প্রার্থী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়ার কাছে সে বার হারতে হয়েছিল। যে প্রসঙ্গে পদ্মশ্রী, অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত ফুটবলারের জবাব, ‘‘আরে মাসের মধ্যে দশ থেকে পনেরো বার আমাকে শিলিগুড়ি আসতে হয়। এখানে আমার বাড়ি রয়েছে। আমি তো বহিরাগত নই। আর সে বার প্রবল বিজেপি হাওয়া ছিল। এ বার শিলিগুড়িতে সেই ঝড় থাকবে না।’’
ভাইচুং প্রার্থী হওয়ায় খুশি প্রাক্তন ফুটবলার গৌতম সরকার। শিলিগুড়ির তৃণমূল প্রার্থী তাঁর ফুটবলার জীবনে যখন প্রথম অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলের জার্সি পরেন, তখন সে দলের কোচ ছিলেন গৌতম।
তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ভাইচুং ভারতীয় ফুটবলের শেষ আইকন। যুবসমাজের মনটা বুঝতে পারবে ভালই। ও যদি ডাকে তা হলে ওর প্রচারে যেতেই পারি।’’
আর এই আইকন শব্দটার জন্যই পুরো অন্যরকম প্রতিক্রিয়া সিকিমের তিনকিতাম গ্রাম থেকে তাঁকে ভারতীয় ফুটবলের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ভগীরথ ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। ভাইচুংয়ের ‘মাদার ক্লাব’ ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলের সাফ কথা, ‘‘ভাইচুং যুবসমাজের আইকন। তাই ও ভোটে না দাঁড়ালেই ভাল করত।’’