বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রা। শুক্রবার আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে...’
ডিওয়াইএফআই-এর দফতর দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে সাদা কাপড়ের উপরে রং দিয়ে কথাগুলি লিখে দাঁড়িয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পড়ুয়ারা। আক্ষরিক অর্থেই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উত্তরসূরি ওঁরা। ঘটনাচক্রে, তাঁর পছন্দের কবি রবীন্দ্রনাথের বিপুল সম্ভার থেকে যে সব পঙ্ক্তি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অন্যতম প্রিয় ছিল, তার মধ্যেই পড়ে কথা কয়েকটি। উত্তরসূরিদের হাতে লেখা পোস্টার এ-ও বলছিল, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’— এই প্রশ্ন রেখেই কি বিদায় নিলেন বুদ্ধদেব? সেই বিদায়ে মিশে থাকল নেতাদের শ্রদ্ধা জানানোর ভিড়, আর তাকে ছাপিয়ে যাওয়া জনস্রোতের আবেগ।
তপসিয়ার ‘পিস ওয়ার্ল্ডে’ বৃহস্পতিবার রাখা ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দেহ। জনতার স্রোতে ভাসতে ভাসতেই বেলা ১১টা নাগাদ বুদ্ধদেবের দেহ আনা হয় রাজ্য বিধানসভায়। শববাহী গাড়ির সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘদিনের সতীর্থ সূর্যকান্ত মিশ্র, সুজন চক্রবর্তী, রবীন দেব প্রমুখ এবং প্রয়াত নেতার স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য ও সন্তান সুচেতন। বিধানসভায় ছিলেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, শশী পাঁজা, ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাসেরা। শ্রদ্ধা জানান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এসেছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেন থেকে বুদ্ধদেবের শিল্পনীতির বিরুদ্ধে মাঠে নামা চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নও।
বেলা ১২টার সামান্য পরে সিপিএমের রাজ্য দফতর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সেই মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনে নিয়ে আসা হয়েছিল বুদ্ধদেবের নিথর দেহ। কাকাবাবুর (মুজফ্ফর এই নামেই পরিচিত রাজনীতিতে) মূর্তির সামনে রাখা হয় তাঁর দেহ। শ্রদ্ধা জানান বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, পলিটব্যুরোর সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র, প্রকাশ কারাট, বৃন্দা কারাট, মানিক সরকার, এম এ বেবি, বুদ্ধদেবের বন্ধু তথা সহকর্মী অসীম দাশগুপ্ত-সহ অন্যেরা। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির হয়ে পলিটব্যুরোর সদস্য নীলোৎপল বসু, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের হয়ে কেরলের শিক্ষামন্ত্রী ভি শিভন কুট্টিরা শ্রদ্ধা জানান। চোখে অস্ত্রোপচারের জন্য কলকাতায় আসতে পারেননি ইয়েচুরি। তবে তিনি বলেছেন, ‘‘বাংলার সামাজিক মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো ধরে রাখার জন্য বুদ্ধদেবের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একসঙ্গে বসে আমরা যা আলোচনা করেছি, যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাঁকে কাজ করতে দেখে যা শিখেছি, মনে থেকে যাবে সে সবও।’’
শরিক দলের ডি রাজা, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন চট্টোপাধ্যায় থেকে রাজ্যের মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, বিজেপি নেতা তাপস রায়, শিশির বাজোরিয়া, প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান, প্রদীপ ভট্টাচার্য, অসিত মিত্র, অমিতাভ চক্রবর্তী, শুভঙ্কর সরকার, সন্তোষ পাঠক— শ্রদ্ধা নিবেদনে নেতাদের তালিকা দীর্ঘ। বুদ্ধদেবের যে সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, সেই ক্ষেত্রের ঊষা উত্থুপ, পূর্ণদাস বাউল, সব্যসাচী চক্রবর্তী, শঙ্কর চক্রবর্তী, দেবদূত ঘোষ, চন্দন সেন, প্রমুখও উপস্থিত হয়েছিলেন। ভিড়ের চাপে রাস্তা থেকেই শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে হয়েছে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে।
তবে নেতাদের ভিড় ছাপিয়ে গিয়ে জনতার আবেগের সুতোয় যেন বাঁধা থাকলেন বুদ্ধদেব। এক প্রৌঢ়া ভিড়ের চাপে আলিমুদ্দিনের মূল ফটক পেরোতে পারছিলেন না। ঠায় দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুরোধ করে গেলেন, “এক বার শুধু ওঁর মুখটা দেখব।” একরত্তি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বাগনানের দেবাংশু চক্রবর্তী বললেন, “এই একটা লোক, যিনি আগামী প্রজন্মের কথা ভাবতেন।”
সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফ-এর (অধুনা ডিওয়াইএফআই) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব। আলিমুদ্দিন থেকে ওই সংগঠনের রাজ্য দফতরের সামনে পৌঁছয় বুদ্ধদেবের শববাহী শকট। বাড়ির ব্যালকনি, ছাদ তখন মানুষের দখলে। ভিড়ের চাপে দেহ নামানো যায়নি। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন গৌতম দেব।
শেষমেশ জনস্রোতে ভেসেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দেহ পৌঁছয় এনআরএস-এ। সেখানেই তাঁর দেহদান করা হয়। কথা ছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা মতো বিধানসভায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা হবে। তা হয়নি। কারণ, সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে, শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের এই প্রক্রিয়ার পরে দেহ নিয়ে কোনও কর্মসূচি রাখা যায় না। কিন্তু বিধানসভা থেকে বুদ্ধদেবের দেহ সিপিএমের রাজ্য দফতর ও যুব সংগঠনের দফতরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। হাতে ২০০৬-এর ১২ মে সংখ্যার দলীয় মুখপত্র, যা সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শেষ বার জয়ের। বৃদ্ধের প্রত্যয়, “ফিরিয়ে আনতে চাই এই দিন।” সে দিন ফিরবে কি না, ফিরলে কবে, কী ভাবে— ‘শেষ কথা কে বলবে’, এমন এক প্রশ্নচিহ্নই হয়তো লগ্ন হয়ে রইল শেষযাত্রায়।