আকাশ-ছাওয়া: শিলিগুড়িতে ডাম্পিং গ্রাউন্ডের জঞ্জাল আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ায় সেই ধোঁয়া চলে আসছে শহরে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
ভরা এপ্রিলে কার্শিয়ং ছাড়িয়ে এগোতেই চারপাশে ঘন কুয়াশা। কিন্তু তার রং সাদা নয়। বরং ঘন কালো! এতটাই গাঢ় রং যে ভরদুপুরেও গাড়ির আলো জ্বালাতে হচ্ছে, আবছা চারপাশের জন্য গতিও বাড়াতে পারছেন না চালক।
গত বছরের এপ্রিলে বায়ুদূষণ নিয়ে দার্জিলিঙে বোস ইনস্টিটিউটের আলোচনাচক্রে যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পৌঁছনোর আগে রাস্তাতেই যে দূষণের ছবিটা চাক্ষুষ করব তা ভাবতে পারিনি। কার্শিয়ং থেকে দার্জিলিং, দীর্ঘ পথের পুরোটাই এই কালো ধোঁয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়ে যেতে হয়েছিল। ‘পাহাড়ের রানি’ বলা হয় দার্জিলিংকে। কিন্তু সেই রানির গায়ে এমন কালির পোঁচ কেন?
বিষয়টি স্পষ্ট করেছিলেন বোস ইনস্টিটিউটের পরিবেশবিজ্ঞানী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বলেছিলেন, ‘‘শিলিগুড়িতে মারাত্মক দূষণ। গরমে পাহাড়ের বায়ু হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। সেই শূন্যস্থান পূরণ করে নীচ থেকে উঠে আসা বায়ু। সেই হাওয়ার টানে নীচের ধুলোবালি, কার্বন কণাও পাহাড়ে চলে আসছে।’’ তবে শুধু শিলিগুড়ির ধুলো নয়, বোস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ধরা পড়েছে, পশ্চিমাঞ্চলের খেতে চাষের অবশিষ্টাংশ পুড়নোর ধোঁয়াও ভেসে আসছে দার্জিলিঙে।
শুধু দার্জিলিং নয়, শিলিগুড়ি-সহ গোটা উত্তরবঙ্গেই বায়ুদূষণের রমরমা। শীতকালে পরিস্থিতি এমনই খারাপ হয় যে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় অনেকের। বায়ুদূষণের নিরিখে দিল্লি, কলকাতার মতো বড় বড় শহরগুলির হালহকিকত নিয়ে চর্চা হয়। কিন্তু শিলিগুড়ির মতো জেলা, মহকুমার শহরেও যে ভাবে হাওয়া বিষিয়ে উঠছে তা নিয়ে যারপরনাই শঙ্কিত পরিবেশবিদেরা।
পরিবেশবিজ্ঞানী স্বাতী নন্দী চক্রবর্তীর মতে, উত্তরবঙ্গ জীববৈচিত্রের দিক থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সেখানে এ ভাবে দূষণ বা়ড়তে থাকলে মানুষ তো বটেই, পশুপাখিদেরও ক্ষতি হবে। বায়ুদূষণ বাড়লে জলবায়ুর উপরে তার কুপ্রভাব পড়বে। ফলে সামগ্রিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অবসরপ্রাপ্ত বনকর্তাদের একাংশ বলছেন, লাল পান্ডার মতো সংবেদনশীল প্রাণী শীতপ্রধান এলাকাতেই থাকতে অভ্যস্ত। কিন্তু জলবায়ুর বদল এবং দূষণের ফলে তারা আরও উঁচু এলাকার দিকে সরে যেতে পারে। তেমন কোনও প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করছেন তাঁরা। একই কথা প্রযোজ্য উত্তরবঙ্গের বহু পাখি এবং কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও। ‘‘ওরা সবাই বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত। ফলে কোনও একটি প্রাণীর ক্ষতি হলে তা সামগ্রিক পরিবেশকে ক্ষতি করবে,’’ মন্তব্য এক অবসরপ্রাপ্ত বনকর্তার।
নিরুপায়: শহরের রাস্তায়। নিজস্ব চিত্র
কিন্তু শিলিগুড়ির মতো শহরে এত দূষণ কেন?
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, অতিরিক্ত গাড়ি, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণস্থল— এ সবের ফলেই বায়ুদূষণ হু হু করে বাড়ছে। তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে আশপাশের এলাকার বেশ কিছু পাথর খাদানও। উত্তরবঙ্গের পরিবেশকর্মী অনিমেষ বসুর আক্ষেপ, ‘‘শিলিগুড়ির মতো ছোট শহরেও যদি এ ভাবে বায়ু বিষিয়ে যেতে থাকে তা হলে আগামী দিনে ঘোর বিপদ অপেক্ষা করছে।’’
পরিবেশবিদদের ব্যাখ্যা, শিলিগুড়ি এবং নিউ জলপাইগু়ড়ি দার্জিলিং, সিকিমে ঢোকার মূল রাস্তা। সে কারণেই পর্যটকদের ভি়ড় লেগে থাকে। নিত্যদিন কয়েক হাজার গাড়ির যাতায়াত। সেই গাড়ির ধোঁয়া থেকেই বাতাসে কার্বণ, সালফার ডাই অক্সাইডের মতো বিষকণা মিশছে। এ ছাড়াও শিলিগুড়ি শহরে যে ভাবে বহুতল তৈরি হচ্ছে তা থেকেও সিমেন্ট, বালি এবং কংক্রিটের গুঁড়ো বাতাসে মিশছে। এক পরিবেশবিজ্ঞানী বলছেন, ‘‘নির্মাণস্থল, গাড়ি থেকে দূষণ ঠেকানোর জন্য নিয়মকানুন রয়েছে। কিন্তু এখানে সে সব কতটা মানা হয় সেটাই সব থেকে বড় প্রশ্ন।’’
কিন্তু এই নিয়ম বলবৎ না হলে তো ঘোর বিপদ! পরিবেশবিদেরা বলছেন, দূষণে লাগাম টানতে না পারলে ওই বিষাক্ত কণা মানুষের শরীরে ঢুকবে। তার ফলে ফুসফুস, শ্বাসনালির নানা দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ বাড়বে। ক্যানসারের আশঙ্কা তো ষোলো আনা! কয়েক বছর আগে দার্জিলিঙের লোধামায় কর্মরত এক চিকিৎসক-বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছিলাম, স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই ‘ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ’ (সিওপিডি)-এ ভুগছেন। তবে সেই সংখ্যা কেন বা়ড়ছে বা কতটা বাড়ছে সেই তথ্য ওই চিকিৎসকের হাতে ছিল না।
পরিবেশকর্মীদের অনেকে এ-ও বলছেন, শিলিগুড়ি তো বটেই, দার্জিলিং, কালিম্পং পাহ়াড়েও যে ভাবে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ শুরু হয়েছে তার ফল ইতিমধ্যেই ভুগতে শুরু করেছেন স্থানীয়রা। যেখানে সেখানে নির্মাণকাজ চলছে। ফলে ধুলোবালি আগের থেকে অনেক বেড়ে গিয়েছে। ‘‘দার্জিলিঙে তো লোকেরা স্বাস্থ্য উদ্ধারে যেত। এখন গেলে উল্টে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা রয়েছে,’’ মন্তব্য এক পরিবেশকর্মীর। তাঁর মতে, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণে শুধু কংক্রিট বাড়ে না, কমে গাছও। অথচ বাতাসে কার্বনের পরিমাণ কমাতে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। ওই পরিবেশকর্মী বলছেন, ‘‘পর্যটন নিয়ে সরকার যখন এত উদ্যোগী, তা হলে পর্যটনের কথা ভেবেও তো দূষণে লাগাম টানা উচিত।’’
উত্তরবঙ্গের দূষণ নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করেছিলেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তিনি বলছেন, গাড়ি, নির্মাণশিল্প থেকে দূষণ তো রয়েইছে, তার উপরে রয়েছে ভাগাড় এবং জঞ্জাল পোড়ানোর ঘটনাও। শিলিগুড়ি শহরে যে ভাগাড় রয়েছে তার গা ঘেঁষেই রয়েছে স্কুল। অথচ ওই ভাগাড়ে প্রায়ই আগুন লেগে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। পরিবেশকর্মীদের একাংশের অভিযোগ, এর বাইরেও যত্রতত্র জঞ্জালে আগুন লাগানো হচ্ছে। ‘‘পরিবেশ আইন বলছে, জঞ্জাল পোড়ানো নিষিদ্ধ। কিন্তু তা মানছে কে?’’ মন্তব্য এক পরিবেশবিজ্ঞানীর। সুভাষবাবু বলছেন, উত্তরবঙ্গ দিয়ে উত্তর-পূর্বের প্রচুর পণ্যবাহী গাড়ি যাতায়াত করে। সেগুলির ধোঁয়াও কতটা দূষণ ঘটায় তা দেখা উচিত।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে বলা হচ্ছে, উত্তরবঙ্গের দূষণের অভিযোগ তাদের কাছেও রয়েছে। পরিবেশ আইনের নিয়ম কী ভাবে বলবৎ করতে হবে সে ব্যাপারে নির্দেশিকা জারি করা রয়েছে। সেগুলি যাতে ঠিক মতো জারি করা হয় তা স্থানীয় প্রশাসনকেই দেখতে হবে।
প্রশাসনের তরফে বারবারই দাবি করা হয়েছে, পরিবেশ দূষণ রুখতে তারা তৎপর। কিন্তু প্রয়োজনীয় সব উপকরণ নেই। কিন্তু পরিবেশকর্মীরা বলছেন, সময় হাতে বেশি নেই। কার্বনের তাপশোষণ ক্ষমতা বেশি। ফলে বাতাসে কার্বণের পরিমাণ বা়ড়লে তা বেশি পরিমাণে তাপকে ধরে রাখবে। তাতে উষ্ণায়নও বাড়বে। তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই জলবায়ুর উপরে কুপ্রভাব পড়বে। বদলে যেতে পারে জলবায়ুও। সেই জলবায়ু বদলে গেলে গাছপালা, কীটপতঙ্গ থেকে মানুষ, সবার উপরেই প্রভাব পড়বে। বদলে যাবে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মও।
‘‘সেই বদল কিন্তু ইতিমধ্যেই নজরে আসছে,’’ বলছেন অনিমেষবাবু।