কারামন্ত্রীর পরিদর্শনের পরেও মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বন্দিদের একাংশের সঙ্গে কিছু কর্মীর ‘সুসম্পর্কে’ ছেদ পড়েনি। আইজি-র ভুয়ো পরিচয় দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে ফোনে গত সোমবারই ওই সংশোধনাগার থেকে আরামবাগের এসডিপিও শিবপ্রসাদ পাত্রের কাছে টাকা দেওয়ার নির্দেশ যায়। তার তদন্তেই ফের সেই ‘সুসম্পর্ক’ প্রকাশ্যে এল।
মঙ্গলবার ওই সংশোধনাগারে যান এসডিপিও (আরামবাগ) এবং আরামবাগের আইসি। তাঁদের প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, মোবাইল ফোনটি জেলকর্মী সৌরেন্দ্রনাথ দাসের। টাকা চেয়ে যে অ্যাকাউন্ট নম্বর দেওয়া হয়, সেই অ্যাকাউন্টটিও তাঁর। ফোনের ‘সিম কার্ড’টি ছিল পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা বিকাশ দাসের নামে। কিন্তু ‘সিম’টি তাঁর খোয়া যায় বলে থানায় অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে সৌরেন্দ্রবাবু কবুল করেছেন, ফোনটি তিনি বন্দি পলাশ মণ্ডলকে দিয়েছিলেন। তবে, পলাশের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগসাজশ নেই। পলাশই ফোন করে টাকা চায় বলে পুলিশের দাবি। পলাশের বিরুদ্ধে এখনও কোনও এফআইআর হয়নি। সৌরেন্দ্রবাবু এবং বিকাশবাবুর বিরুদ্ধে আরামবাগ থানায় এফআইআর করেন এসডিপিও। কারা দফতরের অনুমতি নিয়ে আজ, শুক্রবার পলাশকে জেরা করা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে, মোবাইল ফোনটি এখনও পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি।
বৃহস্পতিবার ঘটনার তদন্তভার তুলে দেওয়া হয় আরামবাগের আইসি অলোকরঞ্জন মুন্সির হাতে। এ দিন ওই সংশোধনাগারে যান মেদিনীপুর রেঞ্জের ডিআইজি (কারা) বিপ্লব দাস। তবে, কারা দফতর এখনও ওই ঘটনায় তদন্ত শুরু করেনি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে হুগলি জেলা পুলিশের একাংশ। তাদের অভিযোগ, জেলে প্রতারণা চক্রের হদিশ মিললেও কারা দফতর উদাসীন। মেদিনীপুর রেঞ্জের ডিআইজি (কারা) বিপ্লববাবু বলেন, “পুলিশ তদন্ত করছে। পুলিশ তদন্ত রিপোর্টে কিছু জানালে তখন তা দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।”
কারামন্ত্রী হায়দার আজিজ সফি বলেন, “খবরের কাগজেই আমি ঘটনাটি সম্পর্কে পড়েছি। এডিজি (কারা)-কে বলেছি, পুরো ঘটনাটি খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাতে। তবে, এফআইআর যে হেতু হয়েছে, তাই কিছু অন্তত ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তদন্তে যদি কেউ দোষী প্রমাণিত হয়, তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কী হয়েছিল সোমবার?
সে দিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ এসডিপিও (আরামবাগ) শিবপ্রসাদ পাত্রের কাছে আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মার নাম করে একটি ফোন আসে। ফোনে বলা হয়, এসডিপিও-র এলাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর শেষকৃত্যের জন্য ২০ হাজার টাকা জোগাড় করতে দিতে হবে। একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরও দেওয়া হয়। এসডিপিও বিষয়টি হুগলির পুলিশ সুপারকে জানান। পুলিশ সুপারের পরামর্শ মতো তদন্ত করে খোঁজ পান ফোনটি পশ্চিম মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার থেকে এসেছে। ওই সংশোধনাগারের সুপার স্বরূপ মণ্ডল অবশ্য জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে পলাশ ফোন করে টাকা চাওয়ার কথা অস্বীকার করেছে।
ওই সংশোধনাগারের বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। জঙ্গলমহলের জেলা হওয়ায় মাওবাদী নাশকতার মামলায় ধৃত বিচারাধীন বহু বন্দিই এক সময় এখানে ছিলেন। এখনও কল্পনা মাইতি ওরফে অনু-সহ কয়েকজন মাওবাদী নেতা-নেত্রী সংশোধনাগারে রয়েছেন। তারপরেও এখানকার নিরাপত্তা যথেষ্ট আঁটোসাটো নয় বলেই অভিযোগ। এই সংশোধনাগারে মোবাইল উদ্ধারের ঘটনাও নতুন নয়। কখনও জেলের মধ্যে থেকে মোবাইল পাওয়া যায় আবার কখনও মেলে মাদকদ্রব্য। কারারক্ষীদের একাংশের হাত ঘুরেই জেলে এ সব ঢোকে বলে অভিযোগ। বছর দেড়েক আগে রাজ্য গোয়েন্দা দফতর এ নিয়ে কারা দফতরকে সতর্ক করেছিল। জানানো হয়েছিল, জেলের এক কর্মীর মদতেই বন্দিদের কাছে মোবাইল, টাকা, মাদকদ্রব্য, গোপন চিঠি পৌঁছচ্ছে। বন্দিদের একাংশের সঙ্গে জেলের কয়েক জন আধিকারিক-কর্মীর সুসম্পর্ক রয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।
দিন কয়েক আগে ওই সংশোধনাগার পরিদর্শনে এসেছিলেন কারামন্ত্রী। জেলের মধ্যে থেকে মোবাইল উদ্ধার প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল, “যে কোনও অভিযোগ এলেই তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হয়। গত ছ’মাসে রাজ্যের বিভিন্ন জেল থেকে পাঁচশো মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। মেদিনীপুরে সংখ্যাটা অনেক কম।”
কিন্তু ফের ওই সংশোধনাগার থেকেই মোবাইলে পুলিশকর্তার কাছে টাকা চাওয়ার কথাই সামনে এল। ফের উঠল জেলকর্মী-বন্দির যোগাযোগের অভিযোগও।