অপরিসর পুরনো সাবওয়ে (বাঁদিকে)।
ঝাঁ-চকচকে হয়েছে শহর। মাথা তুলে চলেছে একাধিক বহুতল। গোটা শহর কার্যত কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে গিয়েছে। জীবনযাত্রার মানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও নাগরিকদের পরিষেবা দেওয়া ক্ষেত্রে হুগলির এই জনপদ নিজের ব্যর্থতা পুরোপুরি ঘোচাতে পারেনি। অন্তত শহরবাসীর অভিজ্ঞতা তাকেই মান্যতা দেয়।
আবাসনের চাপে শহরের নাভিশ্বাস উঠলেও গড়ে ওঠেনি কোনও উন্নত মানের হাসপাতাল। স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে পুরসভা পরিচালিত একটি মাত্র চিকিত্সাকেন্দ্র। অভিযোগ, সেখানেও সব সময় চিকিত্সকের দেখা মেলে না। গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে এখানে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে, তবে তা এখনও মানুষের ভরসা আদায় করতে পারেনি। ফলে শহরবাসীকে আজও শহরের বাইরে যেত হয় ভাল চিকিত্সা পরিষেবা পেতে। ছুটতে হয় শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া বা কলকাতায়। অভাব রয়েছে নাসির্ংহোমেরও। আশপাশের আর পাঁচটা মফস্সল শহরের মতো এখানে নার্সিংহোম গড়ে ওঠেনি। এক সময় কোন্নগর রবীন্দ্রভবনের কাছে একটি নার্সিংহোম হয়েছিল। বেশ কিছু দিন ধরে সেটিও বন্ধ।
পুর-কর্তৃপক্ষের অবশ্য বক্তব্য, বছর দেড়েক ধরে চিকিত্সাকেন্দ্রের পরিষেবা বাড়ানো হয়েছে। প্রসূতিদের চিকিত্সার পাশাপাশি সেখানে আইসিসিইউ, আইটিইউ-র মতো পরিষেবাও চালু করা গিয়েছে। চিকিত্সকও থাকছেন চব্বিশ ঘণ্টা। স্থানীয় অরবিন্দ রোডের বাসিন্দা এক যুবক অবশ্য বলেন, ‘‘গুরুতর কিছু হলে শ্রীরামপুরে ছুটতে হয়।’’ পুরবাসীর অনুযোগ, যে ক্ষিপ্রতায় শহরের বুকে একের পর এক আবাসন গড়ে উঠছে, চিকিত্সা পরিষেবার ক্ষেত্রে সেটা হলে শহরবাসী বাড়তি ‘অক্সিজেন’ পেতেন।
গত কয়েক বছরে অবশ্য পুর-এলাকায় বেশ কিছু কাজ হয়েছে। পুরসভা এবং এইচআরবিসি-র উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হচ্ছে। কাফেটেরিয়া হচ্ছে রেল স্টেশনের কাছে। খোলনলচে বদলে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে পুরভবন। ঢেলে সাজা হয়েছে গঙ্গার ঘাট। চওড়া করা হয়েছে শহরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। স্টেশন সংলগ্ন ক্রাইপার রোড হকারমুক্ত হওয়ায় সুবিধা হয়েছে যান চলাচলের। এসি চ্যাটার্জি রোডও চওড়া করা হয়েছে। কোন্নগর থেকে হিন্দমোটর পর্যন্ত রেল লাইনের ধার ঘেঁষে দেড় কিলোমিটার নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে। তবে শহরের মূল রাস্তা জিটি রোড যানজটমুক্ত করা যায়নি। শহরে গাড়ি দাঁড়ানোর নির্দিষ্ট জায়গা না থাকা দিনকে দিন যাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলছে। অপরিকল্পিত ভাবে বাটার মোড়ের দু’ধারে ট্যাক্সি থেকে শুরু করে অটোরিকশা, রিকশা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে অপরিসর রাস্তায় জট পাকিয়ে যায় গাড়িঘোড়ার। হাঁটার পথ মেলে না। শহরে আবাসনের জন্য জায়গার অভাব না হলেও গাড়ি দাঁড়ানোর জায়গা বা স্ট্যান্ডের অভাব নিত্য টের পান শহরবাসী।
স্টেশনের একমাত্র সাবওয়েতে সাইকেল, রিকশা, মোটর বাইকের ভিড়ে চলাচল করা দায়। সেই ভিড় এড়াতে এবং বড় গাড়ি যাতায়াতের জন্য কয়েক বছর আগে আর একটি সাবওয়ে তৈরি করা হয় বটে, কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে তা সমস্যা মেটাতে পারেনি। একে প্রায়ান্ধকার। তার উপরে সামান্য বৃষ্টি হলেই জল দাঁড়িয়ে যায়। ফি বর্ষায় সাবওয়ে থাকে জলের তলায়।
স্টেশনের কাছে অটো বা রিকশার নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড না থাকার পাশাপাশি সমস্যা রয়েছে কোন্নগর-পানিহাটি ফেরি পরিষেবা নিয়েও। অভিযোগ উঠেছে ঘাটের লিজ গ্রহীতা সংস্থার কাজে পুরসভার ‘অনৈতিক’ হস্তক্ষেপের। যদিও এ ধরনের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন পুর কর্তৃপক্ষ।
রবীন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র সেন, শ্রীরামকৃষ্ণ, দ্বারকানাথ, অবনীন্দ্রনাথ, ঋষি অরবিন্দের স্মৃতিধন্য এ শহরে সংস্কৃতি বা নাট্যচর্চার জন্য রবীন্দ্রভবন ছাড়া সে রকম প্রেক্ষাগৃহ নেই। রবীন্দ্রভবনের পরিকাঠামো অত্যাধুনিক মানের না হলেও উপযুক্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চের অভাব সেখানেই মেটাতে হয় সংস্কৃতিপ্রেমীদের।
শুধু বর্তমান সরকারের আমলেই নয়, বাম আমল থেকেই নাগরিকেরা দেখে আসছেন, প্রোমোটারি রাজের হাতে কী ভাবে বদলে যাচ্ছে তাঁদের শহর। এক সময় এই শহর ছিল নানা শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা। কিন্তু সেই ছবিও আজ মলিন। একের পর এক কারখানা বন্ধের মিছিলে হাতে গোনা যে কয়েকটি চালু, তার শ্রমিকেরাও খুব ভাল নেই। শিল্পের দৈন্যতায় শ্রমিক মহল্লায় হাহাকার। গোটা শহর জুড়ে এখন একটাই ‘শিল্প’ প্রোমোটারি। স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে তাকালেই চোখ আটকে যাবে একাধিক পেল্লাই বহুতলে।
প্রোমোটারি শিল্পের রমরমায় শহরে লাগামছাড়া হয়েছে দুষ্কৃতীরাজও। বন্ধ থাকা কল-কারখানার জিনিসপত্র ফাঁকা করা থেকে শুরু করে পুরনো বাড়ি ভেঙে, জলাশয় ভরাট করে ফ্ল্যাট বানানোর প্রতিযোগিতায় কোন্নগরের অন্ধকার জগত্ এক সময় শাসন করেছে হুগলির ‘ডন’ হুব্বা শ্যামল। বছর কয়েক শ্যামল খুন হয়। তার পর থেকে অন্ধকার জগতের ক্ষমতা হাতে তুলে নিয়েছে আর এক সমাজবিরোধী রমেশ মাহাতো। ক্ষমতা কায়েম রাখার দৌড়ে প্রায়ই ঘটছে নানা অপরাধ। যা আতঙ্কিত করছে শহরবাসীকে। আঘাত করছে সুস্থ সংস্কৃতিকে।
আর তাই বোধহয়, শহরের প্রবীণ নাগরিকের গলায় শোনা যায়, “প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কিছু দূর এগোন যায়/ তারপরে আসে বিনাশের পালা,’....
(চলবে)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর কোন্নগর’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ,
জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।