অভ্যাস মতো শনিবার সকালেও খবরের কাগজটা হাতে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুরো পড়লেন না। সোফার এক পাশে মুড়ে রেখে দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার সামনে বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘বারাসতের রাজীবের অপরাধীদের সাজা হল। আমাদের আজও কিছু হল না।’’
তিনি পাঁচ বছর আগে বালির নিহত তৃণমূল নেতা তপন দত্তের স্ত্রী প্রতিমা দত্ত। যিনি আজও স্বামীর মৃত্যুর প্রকৃত বিচারের আশায় সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে অপেক্ষা করে রয়েছেন। তাই শনিবার সংবাদপত্রে রাজীব দাস হত্যায় তিন অভিযুক্তের যাবজ্জীবন শাস্তির খবর দেখে একটু মুষড়ে পড়লেন। প্রথমে অবশ্য বললেন, ‘‘রাজীবের অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে। এর জন্য আনন্দ হচ্ছে। ওর দিদির লড়াই সার্থক হল।’’ পরক্ষণেই বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘‘আমাদের কী হবে? এখনও কিছুই হল না। সিআইডির ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিটের জন্য পাঁচ অভিযুক্তই বেকসুর খালাস পেল।’’
যদিও ২০১১-এর ৬ মে রাতে বালির লেভেল ক্রসিংয়ের সামনে তৃণমূল নেতা তপন দত্ত গুলিতে খুন হওয়ার পরে নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সিআইডি-র হস্তক্ষেপ দাবি করেন প্রতিমাদেবী। কিন্তু এখন আর রাজ্যের তদন্ত সংস্থার উপর কোনও ভরসাই নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘সিআইডি তদন্ত শুরুর পরেই বুঝেছিলাম শাসক দলের নির্দেশ মতো সব হচ্ছে। তাই তিন বছর আগেই সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছি।’’ এ দিন সালকিয়ার প্রতিবাদী যুবক অরূপ ভাণ্ডারীর বাবার সিবিআই তদন্ত চাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে প্রতিমাদেবী বলেন, ‘‘রাজ্যের সব অপরাধেরই সিবিআই তদন্ত হওয়া উচিত। না হলে কোনও অপরাধীই ধরা পড়বে না। সিআইডি হল রাজ্যের লাল-নীল সুতো বাঁধা টিয়াপাখি।’’
প্রতিমাদেবী জানান, তাঁর দাবি মতো তপনবাবুর খুনের ঘটনার ছ’দিন পরে ১২ মে সিআইডি তদন্ত ভার হাতে নেয়। তখন প্রতিমাদেবী মন্ত্রী অরূপ রায়-সহ কয়েক জন তৃণমূল নেতা ও দুষ্কৃতীদের নাম মিলিয়ে মোট ১৬ জনের নামে একটি অভিযোগ সিআইডি-র কাছে জমা দেন। রমেশ মাহাতো, ষষ্ঠী গায়েন-সহ পাঁচ জন গ্রেফতার হলেও পরে তাঁরা জামিন পেয়ে যান। ২০১১-এর ৩১ অগস্ট সিআইডি প্রথম চার্জশিট পেশ করে। তাতে ওই ১৬ জনের নামের উল্লেখ ছিল। প্রতিমাদেবীর অভিযোগ, আচমকাই সিআইডি-র তদন্তের গতিবিধি বদলে যায়। ২৬ সেপ্টেম্বর পেশ করা হয় সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট। তাতে ধৃত পাঁচ জনের সঙ্গে দুই দুষ্কৃতীর নাম জুড়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, অরূপ রায়-সহ ১১ জনের নাম বাদ যায় চার্জশিট থেকে।
এ দিন প্রতিমাদেবী জানান, নাম বাদ যাওয়ার পরে রাজ্যের তদন্তের উপর আস্থা হারিয়ে সিবিআই তদন্তের আবেদনের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। সেই মতো ২০১২ সালের ১৯ জুন হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। এর পরেই ২৯ অগস্ট হাওড়া আদালতে তপনবাবুর খুনের ঘটনার চার্জ গঠন করে সিআইডি। টানা তিন বছর বিচার পর্ব চলার পরে জানুয়ারিতে হাওড়া আদালত পাঁচ জনকেই বেকসুর খালাস করে। মামলার কাগজপত্র দেখতে দেখতে প্রতিমাদেবী এ দিন বলেন, ‘‘এত বছর ধরে সিবিআইয়ের জন্য লড়াই করছি। প্রয়োজনে আরও অপেক্ষা করব।’’ আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি সিবিআই তদন্তের আবেদন নিয়ে হাইকোর্টে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে শুনানি রয়েছে।
প্রতিমাদেবীর অভিযোগ, সিআইডি তদন্তের নামে অবিচার করা হয়েছে। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘তিন বছর পরে নিম্ন আদালতের রায় বেরোনোর সময় জানতে পারলাম প্রথমে ভারি কিছু দিয়ে ওঁর মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে ছ’টি গুলি করা হয়। এখনও পর্যন্ত ব্যালেস্টিক রিপোর্ট আসেনি।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, সিআইডি জানিয়েছে পাইপগান দিয়ে গুলি করা হয়েছিল। কিন্তু গুলির যে একটি মাত্র খোল পুলিশ উদ্ধার করেছিল তা রিভলভারের।
পারিবারিক ব্যবসায় ভরসা করে কোনও মতে সংসার চালান প্রতিমাদেবী। তপনবাবুর মৃত্যুর পরে সরকারের তরফে তাঁর বড় মেয়েকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা রাখা হয়নি বলে অভিযোগ। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে প্রতিমাদেবী বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী সকলের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেউ দেখা করেননি।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, মামলা তুলে নিতে বিভিন্ন মহল থেকে তাঁর উপরে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। কখনও হুমকি কখনও মোটা টাকার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। কিন্তু কোনও কিছুতেই দমে যেতে চান না এক সময়ে স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সক্রিয় রাজনীতি করা তৃণমূলের পঞ্চায়েতের সদস্য প্রতিমাদেবী। যদিও এখন আর রাজনীতি করেন না বলেই দাবি তাঁর। বদলে তিনি ‘আমরা আক্রান্ত’ নামে এক সংগঠনের প্রতিনিধি। বারাসত থেকে কামদুনি, সর্বশেষ সালকিয়া যেখানেই প্রতিবাদীর মৃত্যু হয়েছে সেখানেই সংগঠনের সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছেন প্রতিমাদেবী। নিজের জীবনের লড়াইয়ের গল্প বলে সবাইকে সাহস জোগান। আর দিনের শেষে বাড়ি ফিরে স্বপ্ন দেখেন এক দিন তাঁর স্বামীর হত্যা-রহস্যের ধোঁয়াশাও কেটে যাবে।