দুর্ঘটনার শিকার গাড়িটি। শনিবার হুগলির চণ্ডীতলায়। —নিজস্ব চিত্র
মৃত্যুফাঁদ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে আবার মৃত্যু।
না পাল্টাচ্ছে নিয়ম-কানুন, না বাড়ছে পুলিশ প্রশাসনের তত্পরতা। ফলে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানিরও বিরাম নেই এই রাস্তায়।
বর্ধমানের গলসির পরে এ বার হুগলির চণ্ডীতলার কাপাসহাড়িয়া। এক সপ্তাহের মাথায় শনিবার ভোরে ফের দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন একটি গাড়ির চার যাত্রী। গুরুতর জখম হলেন তিন জন।
গলসিতে ‘লেন’ ভেঙে ঢুকে আসা ট্রাকের সঙ্গে একটি গাড়ির সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছিল কলকাতার চার যাত্রী এবং স্থানীয় এক পথচারীর। শনিবার কাপাসহাড়িয়ায় দুর্ঘটনায় হতাহতেরা সকলেই বালি-বেলুড় এলাকার বাসিন্দা। প্রত্যক্ষদর্শী না মেলায় এবং জখমেরা কথা বলার অবস্থায় না থাকায় এ দিনের দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে পুলিশ কিছুটা ধন্দে। তবে, গাড়িটির সামনের দিক যে ভাবে দুমড়ে গিয়েছে, তাতে পুলিশের অনুমান, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও ট্রাক বা সামনে ধীর গতিতে চলা কোনও বড় গাড়িতে ধাক্কা মেরে থাকতে পারে ওই গাড়িটি। চালকের ঝিমুনি আসার জন্যও এই দুর্ঘটনা হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
কারণ যা-ই হোক, ওই সড়কে গাড়িতে যে প্রাণ হাতে করে যেতে হয়, তা মানছেন বহু যাত্রীই। কেননা, ডানকুনি ও দুর্গাপুরের মধ্যে বিস্তৃত এই সড়কে মৃত্যুফাঁদ রয়েছে নানা চেহারায় গাড়ির ‘লেন’ ভাঙা তো রয়েছেই। মালবাহী গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা, বিপজ্জনক ভাবে লরি-ট্রাক থেকে রড বেরিয়ে থাকা, রাতে বহু গাড়ির ‘ব্যাক লাইট’ না জ্বলা, গ্রাম থেকে গরু-বাছুর নিয়ে সড়কে চলে আসা, গতি-নির্দিষ্ট ‘লেন’ না থাকা, আচমকা সামনের গাড়ির গতি কমিয়ে দেওয়া... দুর্ঘটনার কত কারণ! ফলে, গাড়ি-চালক একটু অসতর্ক হলেই সাক্ষাত্ মৃত্যু। ঠিক যে ভাবে এক সপ্তাহ আগে গলসিতে পাঁচ জন এবং এ দিন কাপাসহাড়িয়ায় চার জন মারা গেলেন।
কাপাসহাড়িয়া মৃতেরা হলেন শঙ্করী ঘোষ (৪০), তাঁর জামাই অমিতাভ গুহনিয়োগী ওরফে মিঠু (২৬), শঙ্করীদেবীর পড়শি ভীম মণ্ডল (৪০) এবং তাঁর পরিচিত শশী চৌধুরী ওরফে ঝিঙ্কা (২৯)। শঙ্করীদেবী এবং ভীমের বাড়ি বেলুড়ের সুভদ্রা নগরে। শশী বালির আনন্দনগরের এবং মিঠু লিলুয়ার চকপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। শঙ্করীদেবী দিনমজুরির কাজ করতেন। বাকিরা রাজমিস্ত্রির।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ একটি গাড়ি ভাড়া করে শঙ্করীদেবী বাপেরবাড়ি কাটোয়ায় একটি পুজো দেখতে যান। সঙ্গে ছিলেন ভীম, শশী-সহ ছ’জন। শনিবার ভোরে ফেরার সময়ে শঙ্করীদেবী তাঁর মা আরতি দাসকে গাড়িতে তুলে নেন। কাটোয়ায় থেকে যান তাঁর ভাই। কাপাসহাড়িয়ায় ঘটনাস্থলেই মারা যান চার জন। আহত আরতিদেবী, শঙ্করীদেবীর প্রতিবেশী হারু দাস এবং আর এক জনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। দুর্ঘটনার সময়ে যাত্রীরা সকলেই ঘুমোচ্ছিলেন। সংঘর্ষের শব্দ পেয়ে আশপাশের হোটেল এবং এলাকা থেকে লোকজন এসে তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
তদন্তকারী এক পুলিশ অফিসার বলেন, “প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান পাওয়া যায়নি। আহতদের সঙ্গে কথা বলে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানার চেষ্টা করা হবে। গাড়িটি বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করানো হবে। তাতেই দুর্ঘটনার কারণ স্পষ্ট হবে।” তবে, এক্সপ্রেসওয়েতে চলার নিয়ম-কানুন কড়া না হলে শীতের মরসুমে এমন আরও দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। কারণ, সড়কে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুক্ত হবে কুয়াশাও।
আর পাঁচটা রাস্তার সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলের বিস্তর ফারাক রয়েছে। কেন না এই সড়ক ব্যবহারের জন্য চড়া হারে ‘টোল’ দিতে হয়। বিনিময়ে নূন্যতম নিরাপত্তার আশা করেন যাত্রীরা। খাতায়-কলমে সড়কে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের মোবাইল ভ্যান, পুলিশ কিয়স্ক থাকে। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়েতে পর পর দুর্ঘটনা সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বারবার বেআব্রু করে দিচ্ছে।
হুগলি জেলা পুলিশের তথ্যই বলছে, বেআইনি ভাবে সড়কের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লরি-ট্রাকের জন্য প্রায়ই দুঘর্টনা ঘটছে। অথচ, সড়কের মধ্যে ৩০ কিলোমিটার অন্তর ‘লে-বাই’ (যেখানে লরি-ট্রাক দাঁড়াতে পারে। চালক-খালাসিরা খাওয়া-দাওয়া বা শৌচকর্ম সারতে পারেন) রয়েছে। কাপাসহাড়িয়াতেও একটি ‘লে-বাই’ রয়েছে। তা সত্ত্বেও ট্রাক দাঁড়াচ্ছে সড়কের ধারেই। বিপদে পড়ছেন সাধারণ যাত্রীরা।
কেন এক্সপ্রেসওয়ের ধারে বেআইনি ভাবে ট্রাক দাঁড়ায়?
পুলিশেরই একটি সূত্র জানিয়েছে, রাত ৮টার পর কলকাতা শহরে মালবাহী গাড়ি ঢুকতে পারে। দূরদূরান্ত থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য যে সব গাড়ি ছাড়ে, তার মধ্যে অনেক গাড়িই নির্দিষ্ট সময়ের আগে ডানকুনিতে চলে আসে। চালকেরা চান কলকাতা যাওয়ার জন্য আগে লাইন দিতে। তার মধ্যে চলে মাল খালাসও। আর গাড়ির চাপ এত থাকে যে ‘লে-বাই’য়ে স্থান সঙ্কুলান হয়। তা ছাড়া, ফলে, আইন ভাঙাটাই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। ঘটছে দুর্ঘটনাও।
দুর্ঘটনা কী কোনও ভাবে রোখা যায় না? অসহায় শোনায় পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের গলা। হুগলির পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী বলেন, “এই সড়ক দিয়ে কলকাতায় যে পরিমাণ মালবাহী গাড়ি ঢোকে, তার সংখ্যা অনেক। পুলিশের একার চেষ্টায় সে সব নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। দুর্ঘটনা এড়াতে সকলের চেষ্টা থাকা দরকার।” জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের তরফে প্রকল্পের এক কর্তা বলেন, “পথচলতি মানুষের নিজস্ব বোধ জরুরি। সব সময় প্রশাসকদের ঘাড়ে দোষ চাপানো যায় না। হাজার হাজার গাড়ি চলে। তাদের কেউ কেউ নিয়ম ভাঙে। পুলিশ দিয়ে সব সময় দুর্ঘটনা রোখা সম্ভব নয়।”
নিয়ম-কানুনে আশু পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা নেই।