গ্যাসের জন্য দোকানে লাইন।
রান্নার গ্যাস বাড়ন্ত, গিন্নির কপালে চিন্তার ভাঁজ। অগত্যা দোকানের সামনে লম্বা লাইন কত্তাদের।
প্রতি বছর উত্সবের মরসুমে এটাই রোজনামচা। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। কোথায় যাচ্ছে এত গ্যাস সিলিন্ডার? স্বাভাবিক প্রশ্ন গৃহস্থের।
তেল সংস্থাগুলি উত্সবের মরসুমে ছুটিছাটার কারণে গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন হওয়ার কারণ দেখালেও সমস্যার কারণ যে আরও কিছু তারই খোঁজ মিলেছে অন্ততর্দন্তে। দেখা গিয়েছে, ঘুরপথে কখনও অটোর ইঞ্জিনে, আবার কখনও হোটেল বা মেলার খাবারের দোকানের হেঁশেলে খরচ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক সিলিন্ডার। হুগলি এবং হাওড়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়েছে এমনই ছবি।
রান্নার গ্যাসের একটা বড় অংশই অটোরিকশা বা অন্য গাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বস্তুত যখন থেকে গ্যাস চালিত অটোর যাত্রা শুরু হয়েছে তখন থেকেই উঠছে এই অভিযোগ। এমনকী চোরাপথে গাড়িতে গ্যাস ভরার অভিযোগও উঠেছে। দেখা গিয়েছে, বহু জায়গায় বাড়ির ভিতরেই বিপজ্জনকভাবে গাড়িতে গ্যাস ভরার বন্দোবস্ত রয়েছে। অভিযোগ যে মিথ্যে নয়, ইদানীং তার একাধিক প্রমাণ মিলেছে পুলিশি হানায়। সম্প্রতি হুগলি মোড়ে এমনই একটি বাড়িতে হানা দিয়ে অনেকগুলি বাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার (ডোমেস্টিক) উদ্ধার করে এনফোর্সমেন্ট শাখা। বাজেয়াপ্ত করা হয় একটি অটোরিকশা। গ্রেফতার হয় একজন। সেখানে যন্ত্রের সাহায্যে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের করে তা গাড়িতে ভরা হত বলে অভিযোগ। কিছুদিন আগে শেওড়াফুলিতেও এমন অসাধু কারবারের হদিস পায় পুলিশ। বমাল গ্রেফতার হয় দু’জন।
অভিযোগ, বৈদ্যবাটি, শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুরের অনেক অটোচালকই ওই জায়গায় গ্যাস ভরতে যেতেন। বছর খানেক আগে শ্রীরামপুরের মল্লিকপাড়ায় এবং শেওড়াফুলি স্টেশনের অদূরে এমনই একটি চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ। সেখান থেকেও খালি এবং ভর্তি অবস্থায় প্রচুর সিলিন্ডার উদ্ধার হয়। সেখানে অবশ্য ছবিটা ছিল অন্যরকম। ঘুরপথে ডোমেস্টিক সিলিন্ডার থেকে কমার্শিয়াল সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে তা বেশি দামে বাজারে বিক্রি করা হত।
তবে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ অভিযানেও পরিস্থতির খুব একটা হেরফের হয়নি। তবে গ্যাসের এই কালোবাজারি নিয়ে অটোচালকেরা তেল সংস্থাগুলির পরিকাঠামোর অভাবকেই দায়ী করছেন। আগে অটো পেট্রোলে চলত। পরিবেশ দূষণের কারণে কয়েক বছর আগে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তে গ্যাসচালিত অটো নামায় প্রশাসন। দুই জেলার বিভিন্ন রুটের অটো-চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, গ্যাসের অটো রাস্তায় নামানো হলেও সেই অনুযায়ী পর্যাপ্ত গ্যাস-স্টেশন করা হয়নি। যেমন উলুবেড়িয়া মহকুমায় একটি পাম্পেও অটোয় গ্যাস ভরার ব্যবস্থা নেই। সেখানকার অটো চালকদের গ্যাস ভরতে অগত্যা পাঁচলায় যেতে হয়। তাঁদের অনুযোগ, গ্যাস ভরতে যেতে-আসতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। সময়ও নষ্ট হয় অনেক। হুগলির চণ্ডীতলা-১, চণ্ডীতলা-২, সিঙ্গুর, হরিপাল-সহ নানা জায়গায় একই সমস্যা। আর এই সমস্যার সুযোগ নিয়েই বিভিন্ন জায়গায় রমরমা বেড়েছে অসাধু এ সব চক্রের।
হোটেলে রান্না চলছে ডোমেস্টিক সিলিন্ডারে। উলুবেড়িয়ায় নিজস্ব চিত্র।
অনেক সময় আবার টানা কয়েক দিন ধরে পাম্পে গ্যাস না থাকার সমস্যাতেও ভুগতে হয় অটোচালকদের। সেই সময় রাস্তায় অটো চালাতে ওই সমস্ত অসাধু কারবারিদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না বলে জানিয়েছেন বহু অটোচালক। এমন অভিযোগও উঠেছে, কিছু বেশি টাকায় রাস্তা থেকেই সিলিন্ডার নির্দিষ্ট গ্রাহকের কাছে পৌঁছনোর পরিবর্তে অন্যত্র চলে যায়। ফলে কৃত্রিম অভাব তৈরি হয়। যাঁর সেদিন গ্যাস পাওয়ার কথা, তাঁকে গ্যাস পেতে বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হয়। কখনও কখনও মাস পেরিয়ে গেলেও গ্যাস মেলে না। ফলে বাড়তে থাকে চাহিদা। হুগলি জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা জানান, দু’-একটি জায়গায় হানা দিয়ে এ সব অভিযোগের প্রমাণ মিলিছে ঠিকই। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা না হলে, সমস্যা মেটানো অসম্ভব।
গ্যাসের কালোবাজারি নিয়ে উলুবেড়িয়ায় ভারত পেট্রোলিয়ামের বটলিং প্লান্ট সূত্রের খবর, নিয়ম মেনেই ডিস্ট্রিবিউটরদের গ্যাস সরবরাহ করেন তাঁরা। ডিস্ট্রিবিউটকরাও গ্রাহকেকর কাছে তা নিয়মমাফির সরবরাহ করেন। কিন্তু তারপর এক অসাধু চক্র রয়েছে, যারা কালোবাজারি করে কৃত্রিম অভাব তৈরি করছে।
অবশ্য শুধু গাড়িতেই নয়, নজরদারির ফাঁক গলে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁতেও কমার্শিয়াল সিলিন্ডারের বদলে ডোমেস্টিক সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ। উলুবেড়িয়া মহকুমার বহু হোটেলেই এই ছবি চোখে পড়বে। উলুবেড়িয়া বাজার কমিটির সম্পাদক গৌর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অনেক রেস্তোরাঁয় ডোমেস্টিক সিলিন্ডার ব্যবহৃত হয়, এটা মিথ্যা নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রশাসনও কোনও ব্যবস্থা নেয় না। পুজোর মরসুমে প্রচুর ডোমেস্টিক সিলিন্ডার ঘুরপথে হোটেলে চলে আসে।’’ আর এ সবের জন্যই কোথাও অর্ডার দেওয়ার পনেরো দিন পরে গ্যাস মিলছে, কোথাও আবার সেই সময়সীমা এক-দেড় মাস পেরিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ সাধারণ গ্রাহকদের। স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁর মালিক শেখ রেজ্জাক মোল্লার কথায়, ‘‘নিয়ম মেনে কমার্শিয়াল সিলিন্ডার এনেই এখানে রান্না করা হয়। তবে পয়সা বাঁচাতে অনেকেই তা করে না। আমরাও চাই প্রশাসন এ ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ করুক। তা না হলে এই অনিয়ম চলতেই থাকবে।”
কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
গ্যাস সংস্থাগুলির বক্তব্য, এই অনিয়ম রোখার দায়িত্ব মূলত জেলা এনফোর্সমেন্টে (ডিইবি)। কিন্তু তাদের যা পরিকাঠামোর হাল, তাতে বড় ধরনের অভিযান দূরঅস্ত, বহু ক্ষেত্রে চোখ মেলে অনিয়ম দেখা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। দফতরের অফিসাররাও কার্যত পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন।
হাওড়া ডিইবি-র ইনস্পেক্টর প্রবীর মুহুরী বলেন, ‘‘এ ধরনের অভিযান চালানোর উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। পর্যাপ্ত গাড়ি, কর্মীরও অভাব রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।’’