তখন সকাল ১০টা।
আমতা আদালত চত্বর পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। কড়া নিরাপত্তা। হাজির পুলিশের পদস্থ কর্তারাও। এক প্রান্তে গাছের নীচে কয়েক জন যুবকের জটলা। অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ়া। তাঁকে ঘিরে দুই মহিলা পুলিশ-সহ চার পুলিশকর্মী। কিছু ক্ষণের মধ্যেই শুরু হওয়ার কথা আমতা গণধর্ষণ-কাণ্ডের প্রথম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ। কিন্তু তা আর হল কই?
সোমবার আমতার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর মুহূর্তেই মামলার সরকারি আইনজীবী নন্দ হাজরা বিচারক শ্যামলকুমার রায়চৌধুরীর কাছে লিখিত আবেদনে জানিয়ে দিলেন, ‘অনিবার্য কারণে’ তিনি এই মামলা থেকে সরে যাচ্ছেন। সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সেই প্রৌঢ়া। বুঝে গেলেন সাক্ষ্যগ্রহণ আর হবে না। পুলিশ প্রহরাতেই দোতলার এজলাস থেকে নীচে নেমে এলেন প্রৌঢ়া। তাঁর মুখে একরাশ হতাশা। এগিয়ে এলেন ছেলে এবং দেওর। তাঁদের দিকে তাকিয়ে প্রৌঢ়া বলে উঠলেন, “আজ আর কিছু হল না।”
মুক্তিরচক গ্রামের এই প্রৌঢ়াই ওই গণধর্ষণ কাণ্ডের প্রধান সাক্ষী। গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁর জা এবং পুত্রবধূকে জনা দশেক যুবক গণধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। বাড়ির পাঁচিলের দরজা ভেঙে ঢোকে দুষ্কৃতীরা। তার আগে এলাকার ট্রান্সফর্মারের তার কেটে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। হামলার সময়ে প্রৌঢ়ার পুত্রবধূর কোল থেকে এক বছরের শিশুকন্যাকে কেড়ে উঠোনে ফেলে দেয় দুষ্কৃতীরা। বাড়ি থেকে কোনও মতে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে গ্রামের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে খবর দেন ওই প্রৌঢ়া। রাতেই গ্রামে হানা দিয়ে পুলিশ পাঁচ জনকে ধরে। পরে ধরা পড়ে আরও চার জন। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতাও রয়েছেন। ধৃতদের মধ্যে ছ’জন কলকাতা হাইকোর্ট থেকে পরে জামিন পান। বাকি তিন জন রয়েছে জেল-হাজতে।
সরকারি আইনজীবী নিয়োগ না হওয়ার জন্য বার বার শুনানি পিছিয়েছে এই মামলার। শেষ পর্যন্ত একজন সরকারি আইনজীবী নিয়োগ হওয়ায় আমতা আদালতে এ দিন ছিল ওই গণধর্ষণ মামলার প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ। প্রথম দিনে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল ওই প্রৌঢ়ার। তিনিই থানায় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
গাছের নীচের জটলাটি ছিল জামিনে মুক্তি পাওয়া ছয় অভিযুক্তের। তাদের মধ্যে ছিল প্রধান অভিযুক্ত বরুণ মাখালও। তা ছাড়া, জেল হাজতে থাকা বাকি তিন অভিযুক্তকেও পুলিশ গাড়িতে করে আদালতে আনে। যদিও তৃণমূলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অভিযুক্তেরা যে দলেরই হোক না কেন, আইন চলবে তার নিজের পথে।
কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাড়ে ১০টায় অতিরিক্ত দায়রা বিচারক শ্যামলকুমার রায়চৌধুরীর এজলাসে উঠল মামলা। হাজির হলেন বাদী ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা। সাক্ষীর কাঠগড়ায় তোলা হল ওই প্রৌঢ়াকে। আচমকা মামলার সরকারি আইনজীবী নন্দবাবু বিচারকের কাছে চিঠি দিয়ে মামলা থেকে সরে যাওয়ার কথা জানালেন। ফলে সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত হয়ে গেল।
আদালত থেকে বেরিয়ে ওই প্রৌঢ়া এগিয়ে গিয়েছিলেন ছেলে এবং দেওরের সঙ্গে একটু কথা বলতেই পুলিশ যেন তাড়িয়ে নিয়ে তাঁকে চলে গেল আদালত চত্বর থেকে। পুলিশি ঘেরাটোপে আদালত চত্বর ছাড়ার আগে একবার পিছন ফিরে তাকালেন তিনি। তাঁর চোখে তখন একরাশ শূন্যতা। এরপরে পুলিশের গাড়িতে চড়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন তিনি। হতাশা দেখা গেল তাঁর ছেলের চোখেও। তিনি বলেন, “এতদিন হয়ে গেল। আর কবে শুরু হবে শুনানি?” নিঃশব্দে কাকাকে সঙ্গে নিয়ে আদালত ছাড়লেন তিনিও।