বাদানুবাদ: কেয়া গোস্বামীর (ইনসেটে) মৃত্যুর পরে পুরসভার কর্মীরা এলাকায় মশা নিধনে গেলে বাসিন্দাদের সঙ্গে বচসা বাধে তাঁদের। বুধবার, হাওড়ার ঠাকুর রামকৃষ্ণ লেনে। নিজস্ব চিত্র
ডেঙ্গিতে ফের মৃত্যু হাওড়ায়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায়, হাওড়ার আন্দুল রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হল এক গৃহবধূর। তাঁর ‘ডেথ সার্টিফিকেটেও’ উল্লেখ রয়েছে ডেঙ্গির কথা। মৃতার নাম কেয়া গোস্বামী (২৬)। তাঁর বাড়ি হাওড়া পুরসভার ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত চারাবাগানের ঠাকুর রামকৃষ্ণ লেনে। এ দিকে, মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই চারাবাগান এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। বুধবার দুপুরে হাওড়া পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের র্যাপিড অ্যাকশন টিম ওই এলাকায় মশা তাড়ানোর কামান নিয়ে গেলে উত্তেজিত বাসিন্দারা তাঁদের কাজে বাধা দেন। কর্মীদের ধাক্কা দিয়ে এলাকা থেকে বার করে দেন বলেও অভিযোগ।
এই নিয়ে গত দু’মাসে ডেঙ্গিতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল চার। যার মধ্যে এক সপ্তাহেই মৃত্যু হল দু’জনের। গত তিন দিনে চারাবাগান এলাকায় ১১ জন বাসিন্দা ডেঙ্গিতে আক্রান্ত, পুরসভার সূত্রে এ খবর জেনেই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। এ দিকে, বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত এক বছর ধরে ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে মশা মারার তেল এবং ব্লিচিং পাউডার ছড়াতে পুরকর্মীদের দেখা যায়নি। কয়েক মাস অন্তর কয়েক জন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী শুধুমাত্র বাড়ির বাইরে থেকে ‘কেমন আছেন’ জানতে চেয়ে দায় সেরেছেন। বাড়ি বাড়ি ঢুকে মশার প্রসবস্থল খোঁজা বা লার্ভা ধ্বংস করার কোনও কাজ তাঁরা করেননি বলেই দাবি বাসিন্দাদের।
পুরকর্মীদের একাংশ ডেঙ্গি দমনে যে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা নেননি তা কার্যত মেনে নিয়েছেন হাওড়ার পুর কমিশনার বিজিন কৃষ্ণ। বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে নিচু স্তরের কাজে ফাঁক আছে। সেই ফাঁক ধরার জন্য বিভিন্ন জায়গায় সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসারদের পাঠিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রয়োজনে শো-কজ, সাসপেনশন করা হবে।’’
শুধু চারাবাগানের বাসিন্দারাই নন, হাওড়া জুড়ে একের পরে এক ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মৃত্যুর ঘটনা পুরসভার বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুনে যেন ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। অভিযোগ, এলাকায় কাজ করতে গিয়ে বাসিন্দাদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘুসুড়িতে শিশুকন্যার মৃত্যুর পরে পুর স্বাস্থ্যকর্মীরা বাসিন্দাদের যে ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন, বুধবারও চারাবাগানে সেই ছবি দেখা গেল।
মৃতার শ্বশুর পরেশনাথ গোস্বামীরও অভিযোগ, ‘‘এ বছর পুরসভার কর্মীরা কোনও ওষুধ দিতে আসেননি। তাই এই এলাকায় ডেঙ্গির এত বাড়বাড়ন্ত। এখন এসে কী হবে?’’ কেয়ার এক আত্মীয় বলেন, ‘‘এলাকায় এত মশা যে টেকা যায় না। জানি না এ ভাবে আর কত প্রাণ যাবে।’’
স্ত্রীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন স্বামী রাজকৃষ্ণ গোস্বামী। তাঁদের একটি আট বছরের মেয়েও আছে। সে হিন্দু গার্লস স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। পরিবার সূত্রের খবর, গত ২৯ তারিখ মঙ্গলবার ভাইফোঁটার দিন জ্বর হয় কেয়ার। পরদিনই স্থানীয় এক চিকিৎসককে দেখানোর পরে বৃহস্পতিবার তাঁর রক্ত পরীক্ষা করা হয়। তাতেই ডেঙ্গি ধরা পড়ে কেয়ার। এর মধ্যেই তাঁর বমি ও পেটের গোলমাল শুরু হয়।
চিকিৎসকের পরামর্শে পরিজনেরা শুক্রবারই তাঁকে প্রথমে রামরাজাতলার কাছে একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করেন। সেখানে তাঁর অবস্থা আরও অবনতি হয় বলে অভিযোগ। প্লেটলেট খুব বেশি না কমলেও রক্তচাপ কমতে থাকে। প্রস্রাবের সঙ্গেও রক্ত বেরোতে থাকে। তিন দিন পরে সেখান থেকে তাঁকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে বলা হয়। এর পরেই আন্দুলের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কেয়াকে। মঙ্গলবার বিকেলে ধরা পড়ে প্লেটলেট ৩৩ হাজার থাকলেও ক্রমশ অকেজো হচ্ছিল তাঁর কিডনি, লিভার। কমে যায় রক্তচাপও। এর পরেই মৃত্যু হয় তাঁর।