ক্ষতি: ফাঁকা পড়ে আলো তৈরির কারখানা। ছবি: তাপস ঘোষ
শেডের তলায় চুপটি করে বসে সুজল। টিউবলাইট জ্বলছে। তবে আলোতে সেই ঔজ্জ্বল্য নেই। সুজলের মুখে মাস্ক। কপালে ভাঁজ!
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা সুজল সাহা চন্দননগরের আলো কারখানার শ্রমিক। লকডাউনে তাঁর কাজ বন্ধ। পরিবহণের অভাবে বাড়ি ফিরতে পারেননি। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি দুশ্চিন্তায়। সুজলের মতোই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন চন্দননগরের বিখ্যাত আলোকশিল্পের সঙ্গে জড়িত সকলেই। ভবিষ্যতে শিল্প কোন পথে হাঁটবে, শ্রমিকদের অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে চলছে জল্পনা।
চন্দননগরের আলোকশিল্পের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। কখনও লন্ডনের টেমস উৎসবে, কখনও অমিতাভ বচ্চনের বাড়িতে শোভা পেয়েছে এখানকার আলো। কয়েক মাস আগে ‘ক্রিকেট-দেবতা’ সচিন তেন্ডুলকর পঞ্চমুখে প্রশংসা করেছেন এখানকার আলোর। চন্দননগর লাইট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্তারা জানান, ভদ্রেশ্বর থেকে বাঁশবেড়িয়া পর্যন্ত ছোটবড় মিলিয়ে দেড়শোর বেশি আলো-কারখানা রয়েছে। বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। পরোক্ষ ভাবেও বহু মানুষ যুক্ত। সেই শিল্প এখন ‘নিষ্প্রদীপ’। সৌজন্যে — লকডাউন।
আলোকশিল্পীরা জানান, বর্তমানে এলইডি বা পিক্সেল টুনি দিয়ে আলোকসজ্জা তৈরি হচ্ছে। এই ধরনের টুনি আসে চিন থেকে। এ ছাড়াও কাঁচামাল হিসেবে ফাইবার গ্লাসের শিট, পলিশিট, তার, রং, কাঠামোর জন্য কাঠ, লোহা, স্টিলের তার প্রয়োজন হয়। এগুলি কলকাতা বা স্থানীয় বাজার থেকে আসে। চন্দননগর ডুপ্লেক্সপট্টি দিঘির ধারের আলোকশিল্পী অসীম দে জানান, তাঁর কারখানায় ২৫ জন কাজ করেন মাসিক বেতনের ভিত্তিতে। পুজোর সময় শ্রমিক সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে পুজোর কাজ শুরু হয়ে যায়। এ বারও হয়েছিল। কিন্তু লকডাউনে পরিস্থিতি বিগড়ে গিয়েছে। স্থানীয় শ্রমিকেরা বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন। অন্য জেলা বা রাজ্যের কিছু শ্রমিক ফিরতে পারেননি। তাঁরা কারখানাতেই থাকছেন। তিনিই তাঁদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করছেন।
অসীম বলেন, ‘‘করোনা পরিস্থিতির জন্য পুজোর অর্ডার আসেনি। পুজোয় জৌলুস থাকবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তার মানে কাজও থাকবে না। আমাদের চলবে কী করে?’’ আলোকশিল্পী তপন ঘোষ বলেন, ‘‘আগামী দিনে কী হবে কে জানে! কাজ নেই। শ্রমিকদের পুরো টাকা দিতে পারব না। কিছু দিনের মধ্যে পরিস্থিতি ভাল না হলে আরও সমস্যা হবে। কাজ না হলে বেতনের টাকা জোগাড় করব কী ভাবে?’’
বিষ্ণুপুরে সুজলের বাড়িতে স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং মা আছেন। অসীমের কারখানায় বসে সুজল বলেন, ‘‘এখানে হাত গুটিয়ে বসে আছি। বাড়িতেও ফিরতে পারছি না। সমস্যায় পড়ে গেলাম। কাজ না থাকলে পরের মাস থেকে কী হবে, সেটাই চিন্তার।’’ চন্দননগরের বাসিন্দা, বছর সাতাশের দেবল সাহা শহরের শাওলি-বটতলার আলো কারখানার শ্রমিক। তিনিও বলেন, ‘‘কাজকর্ম শিকেয়। বাড়িতে বসে আছি। বলতে পারেন সেদ্ধ ভাত খাচ্ছি। মালিক বলেছেন, এই মাসে কিছু টাকা দেবেন। আগামী মাসে কী হবে, জানি না।’’
চিন থেকে এলইডি বা পিক্সেল আলো আসা বন্ধ থাকলে কী হবে, ভেবে পাচ্ছেন না আলোকশিল্পীরা। অসীম বলেন, ‘‘সরকার আমাদের পাশে দাঁড়াক। কম সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। না হলে সঙ্কট বাড়বে। সম্ভব হলে এই দেশে ওই আলোর উৎপাদন করা গেলে ভাল হবে।’’ আলোকশিল্পী সংগঠনের সম্পাদক বাবু পালের কখায়, ‘‘চন্দননগরের আলোকশিল্পে বছরে প্রায় একশো কোটি টাকার লেনদেন হয়। লকডাউনে জেরে খুব ক্ষতি হয়ে গেল।’’
আলোর শহরকে এতটা বিবর্ণ কখনও দেখা যায়নি!
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)