সাতটা পঞ্চায়েত। একটি পুরসভার ৩০টা ওর্য়াড। লোকসংখ্যা ২,৯৪,৬২৬ জন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যে রাজ্যে সব চেয়ে বড় বিধানসভা কেন্দ্র। মোট ৩৬৩টি বুথ রয়েছে হুগলির চুঁচুড়া বিধানসভা এলাকায়। যার পুরোটাই দিনরাত চষে বেড়াচ্ছেন বিদায়ী বিধায়ক তপন মজুমদার। ছোট ছোট কর্মিসভা, মিছিল আর সরাসরি ভোটারদের ঘরে পৌঁছে যাওয়া দিয়ে শুরু হয়েছিল প্রচার। শেষ বেলায় তাতে ঝড় তুলেছেন পোড়খাওয়া এই তৃণমূল নেতা। প্রচণ্ড গরমেও কুছ পরোয়া নেই। আসন ধরে রাখতে এতটাই বেপরোয়া তিনি।
কিন্তু এবার কী একটু বেশিই ‘সিরিয়াস’ গত বারের এই বিজয়ী প্রার্থী! জেতা আসনেও এত দৌড়? তা হলে কী ‘ডাল মে কুছ কালা’?
সরাসরি প্রশ্নে কিছুটা চড়া মেজাজেই উত্তর এল বিধায়কের, ‘‘লিখে নিন, ২০০ শতাংশ জিতব।’’ তা হলে এত খাটনি কেন? এবার একটু নরম, ‘‘কোনও যুদ্ধকেই ছোট করে দেখা উচিত নয়। তা ছাড়া মাঠে নেমে সরাসরি লড়াই করে জেতায় কিন্তু বেশি আনন্দ।’’
বস্তুত গতবার শ্রীরামপুর থেকে তুলে নিয়ে এসে জেলা সদরের প্রার্থী করা হয়েছিল তপনবাবুকে। একে অচেনা কেন্দ্র, তার উপর গায়ে এঁটে গিয়েছিল বহিরাগত তকমা। দলীয় সতীর্থরাই বা কেমন ভাবে নেবেন? সব মিলিয়েই দ্বিধার জায়গা ছিলই। ফলে লড়াইটাও ছিল তুলনায় কঠিন। কিন্তু মাঝে কেটে গিয়েছে পাঁচটা বছর। এক সময়ের প্রতিকূলতা এখন বিধায়কের কাছে অতীত। চুঁচুড়ায় নিজস্ব বাড়ি করে সেখানেই থিতু হয়েছেন। কাজের প্রসঙ্গ তুলতেই লম্বা যে ফিরিস্তি দিলেন তা লেখার মতো পরিসর মেলা ভার। তবে এলাকার মানুষ বলছেন, নিজের কেন্দ্রে কাজের ব্যাপারে বিধয়াকের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের টাকায় ৭টি পঞ্চায়েতে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছেন। পাশাপাশি পুর এলাকার জন্য বাঁশবেড়িয়ায় গঙ্গার জল পরিশুদ্ধ করে পানীয় হিসাবে সরবরাহের ব্যবস্থা হয়েছে। চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে সিসিইউ, এসএনসিইউ, ডায়ালিসিস, থ্যালাসেমিয়া ইউনিট হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মাঠগুলির আমূল সংস্কার।
উন্নয়ন নিয়ে বিধায়কের দাবির কথা তুলতেই প্রতিপক্ষ ফরওয়ার্ড ব্লকের চিকিৎসক প্রার্থী প্রণব ঘোষের উত্তর, ‘‘পোলবার একটি আদিবাসী গ্রামে দিন কয়েক আগে প্রচারে গিয়েছিলাম। দেখলাম মানুষের সাঙ্ঘাতিক জলকষ্ট। হয়তো কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু তা মূলত শহরকে কেন্দ্র করেই। সেই সুবিধা গ্রামের মানুষ পাচ্ছেন কোথায়? মানুষ সুযোগ দিলে সেই সব প্রান্তিক মানুষের কথাই আগে ভাবব, যাঁদের কথা এতদিন কেউ ভাবেনি।’’ রাস্তাঘাটের উন্নতি নিয়ে তৃণমূল প্রার্থীকে প্রণববাবুর কটাক্ষ, ‘‘দেবানন্দপুরে গিয়েছিলাম দিন কয়েক আগে প্রচারে। রাস্তাঘাটের এমন অবস্থা, মনে হচ্ছিল গণ্ডগ্রামে এসেছি। কখনও হয়তো রাস্তাঘাট হয়েছিল। তার পর আর কোনও নজর পড়েনি।’’ পোলবার পাওনানের রাস্তাঘাট নিয়েও বামপ্রার্থীর প্রায় একই অভিযোগ।
বিরোধীরা সমালোচনায় মুখর হলেও ভোটপ্রাপ্তির অতীত অঙ্ক শাসকদের দিকেই ঢলে রয়েছে। গত লোকসভায় তৃণমূল পেয়েছিল ১,০২,৩৪৫ ভোট। সিপিএমের প্রাপ্তি ৬৩,৪৯১ ভোট। বিজেপি পেয়েছিল ৪৮,৮৮৪ ভোট ও কংগ্রেস ৮,১০২ ভোট। জোটের অঙ্কে বাম-কংগ্রেস ভোট মিশলে তাতে বিরোধীদের কতটা সুবিধা হবে, এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে বিজেপি-র ভোট কোনও দিকে ঢলে তার উপর। এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তপন পেয়েছিলেন ১,২৭,২০৬টি ভোট। তখন জোট ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে। আর ফব পেয়েছিল ৮২,৬১৪টি ভোট। বিজেপি ৫,৭৬১ ভোট। এবার ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে মিশবে কংগ্রেসের ভোট। তার উপরই নির্ভর করবে শেষ হাসি হাসবে কে?
শাসকদলের প্রার্থী যেখানে আত্মবিশ্বাসী নিজের জনসংযোগ নিয়ে, সেখানে বিরোধী প্রার্থী সাধারণ মানুষের পাওয়া আর না পাওয়ার সুরকেই বোঝার চেষ্টা করছেন। প্রণববাবুর কথায়, ‘‘এর আগেও ভোটে লড়েছি। তবে ক্ষেত্রটা অনেক ছোট ছিল। এই বিধানসভা অনেক বড় এলাকা। বহু মানুষ। তাঁদের সমস্যার কথা শুনছি।’’
এতদিন ছোট মাঠে খেলে এসে হঠাৎ বড় মাঠে নেমে সমস্যা হবে না তো!
এলাকার দীর্ঘদিনের চিকিৎসক ভোটারদের নাড়ি ঠিকই চিনে নেবেন বলে বিশ্বাস দলের।