পাঁচু কাইপুত্র সীমা কাইপুত্র বিকাশ কাইপুত্র
কালো মেঘ জমেছিল। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হয়নি তখনও। যাত্রীরা কেউ কেউ তবু সাবধান করেছিলেন। মিনিট পনেরো পরে তাঁদের আশঙ্কাই সত্যি হয়ে গেল।
রবিবার বিকেলে মাঝগঙ্গায় যাত্রিবাহী নৌকার উপরে বাজ পড়ে প্রাণ হারালেন এক মহিলা-সহ তিন জন। আহত আরও ১৩ জন যাত্রী। যার মধ্যে অন্তত তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। খাস কলকাতার কাছেই বেলুড় থেকে দক্ষিণেশ্বর রুটে এই ঘটনা ঘটেছে। গঙ্গার দু’পাড়ের বাসিন্দা এবং বেলুড়ের অভিজ্ঞ মাঝিরা গঙ্গার পাড়ে বাজ পড়তে অনেক বারই দেখেছেন। কিন্তু মাঝগঙ্গায় নৌকার উপরে বাজ পড়ে এমন মৃত্যুর ঘটনা তাঁরাও চট করে মনে করতে পারছেন না।
আলিপুর হাওয়া অফিসের খবর, রবিবার দুপুরে বর্ধমান ও হুগলি জেলার সীমানায় একটি বজ্রগর্ভ মেঘপুঞ্জ দানা বেঁধেছিল। তার জেরে বর্ধমান-হাওড়া-হুগলি এবং কলকাতার বহু জায়গায় প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। মাঝগঙ্গায় বাজ পড়ার ঘটনাও সেই বজ্রগর্ভ মেঘপুঞ্জের কারণেই বলে আবহবিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
পুলিশ জানায়, এ দিন বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ বেলুড় বাদামতলা ঘাটের কাছে সীমা কাইপুত্র (২৫), পাঁচু কাইপুত্র (৪৫) এবং বিকাশ কাইপুত্র (৩৫) নামে তিন জন নৌকা-আরোহী মারা গিয়েছেন। এঁরা পরস্পর দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে জানা গিয়েছে। পুলিশ জানায়, নৌকোর খালাসি জয়ন্ত নস্কর গুরুতর আহত। রাতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে কলকাতায় বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিতে স্থানান্তরিত করা হয়। বিপাশা কাইপুত্র নামে এক মহিলা যাত্রী এবং তাঁর সন্তানকেও আরজি কর হাসপাতালে আনা হয়েছে। হতাহতদের বেশির ভাগই দত্তপুকুরের নিবাদুই কাইপুত্র পাড়ার বাসিন্দা।
নৌকার মাঝি নিতাই পাল জানান, এ দিন বিকেল সওয়া তিনটেয় বেলুড় কাঠগোলা ফেরিঘাট থেকে জনা বিশেক যাত্রী নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন তিনি। তখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। তবে মাঝি স্বীকার করছেন, আকাশ কালো দেখে কিছু যাত্রী আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁদের বলেন, এমন পরিস্থিতিতে নৌকা চলাচলে সমস্যা হয় না। ওই রুটের অন্য মাঝিরাও বলছেন, মেঘের মধ্যে এর আগেও নৌকা চলেছে। এ দিনও রওনা হওয়ার সময় নদী এমন কিছু অশান্ত ছিল না। আচমকা এমন বাজ পড়বে, তা আঁচ করতে পারেননি মাঝি।
সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সীমা কাইপুত্রের শাশুড়ি। — নিজস্ব চিত্র।
নৌকা নিয়ে রওনা হওয়ার একটু পরে বৃষ্টি শুরু হয়। মুষলধারে জল পড়তে থাকে। যাত্রীরা জানান, বৃষ্টির তোড়ের মুখে নৌকা কিছুটা পাড়ের দিকে সরিয়েও আনা হয়। মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়া হবে কি হবে না, ভাবার আগেই কান ফাটানো শব্দে আছড়ে পড়ে বাজ। নৌকাতেই ছাউনির ভিতরে বসেছিলেন আগরপাড়ার মৌসুমি দে। তাঁর কথায়, ‘‘একটা আগুনের গোলা যেন নৌকার দিকে ধেয়ে এল!’’ পুষ্প কাইপুত্র নামে আর এক মহিলা যাত্রী জানান, মুষলধারে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ভুটভুটি নৌকায় মাথায় পলিথিনের শিট চাপিয়ে বসেছিলেন যাত্রীরা। হঠাৎই কয়েক হাত দূরে ঝলসে ওঠে আলো। সঙ্গে বিকট শব্দ। ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল তাঁর। চোখ খুলতেই দেখলেন, পাশে বসা সীমা কাইপুত্র নামে এক প্রতিবেশী মহিলা নেতিয়ে পড়েছেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আরও কয়েক জন। মাঝি নিতাইও বলছেন, ‘‘বাজ পড়তে চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। চোখ খুলতেই দেখি, কেউ নেতিয়ে পড়েছেন, কেউ বমি করছেন।’’ খালাসি জয়ন্ত ছিলেন অন্য প্রান্তে। নেতিয়ে পড়েন তিনিও।
এই বিপর্যয়ে তাড়াতাড়ি নৌকা ঘুরিয়ে বেলুড় কাঠগোলা ফেরিঘাটে ফিরে যান নিতাই। সেখান থেকেই অন্য নৌকার মাঝি ও স্থানীয় বাসিন্দারা আহত যাত্রীদের বেলুড় শ্রমজীবী এবং হাওড়া জায়সবাল হাসপাতালে নিয়ে যান। শ্রমজীবী হাসপাতালে হাজির হন কাইপুত্র পাড়ার আরও কয়েক জন বাসিন্দা। তাঁদেরই এক জন অভিজিৎ কাইপুত্র জানান, সকাল দশটায় পাড়া থেকে ছোট ম্যাটাডরে চেপে দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন। দুপুরে খাওয়া সেরে তাঁদের জনা দশেক সদস্য বেলুড়ে যান। সেখানে মঠ বন্ধ থাকায় দক্ষিণেশ্বরে ফিরছিলেন।
যাত্রীদের কারও গলার কাছে পুড়েছে, কেউ শুনতে পাচ্ছেন না, কেউ আবার ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিলেন না। শ্রমজীবী হাসপাতালের চিকিৎসক অনিল সাহা বলেন, ‘‘বাজ পড়ার ঘটনায় স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার ফলেই এমন নানা উপসর্গ দেখা যায়।’’
ঘটনাটি শুনেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। আহতদের চিকিৎসার খরচ রাজ্য বহন করবে বলে জানানো হয়। তবে শ্রমজীবী হাসপাতালের তরফে ফণীগোপাল ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘রাজ্যের প্রস্তাবকে সাধুবাদ। তবে এমন ঘটনায় আমরা আগেও টাকা নিতাম না। এ বারেও নেওয়া হবে না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজ্যের সেচ ও জলপথমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আহতদের দেখে আসেন। হাসপাতালে যান কৃষিবিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ও। রাজীববাবু বলেন, ‘‘বৃষ্টির মধ্যে নৌকা চালানো ভুল হয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে এমনটা না হয়, সে দিকে নজর রাখা হবে।’’
প্রশ্ন উঠেছে, ঝড়বৃষ্টির মরসুমে নৌকা চালানোর নিয়মকানুন সর্বত্র ঠিকমতো মানা হয় কি? প্রশাসন সূত্রের খবর, নদীপথে প্রত্যেকটি রুটে যাতায়াতের নিয়ম ওই রুটের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই স্থির করেন। বড় ধরনের দুর্যোগের ক্ষেত্রে অবশ্য সর্বত্র একযোগে নৌকা বা লঞ্চ বন্ধ রাখা হয়। দক্ষিণেশ্বর-বেলুড় রুট পরিচালন সমিতি সূত্রের খবর, দুর্যোগের আগাম সতর্কতা পেলে তাঁরা নৌ-চলাচল বন্ধ রাখেন। কিন্তু কালবৈশাখীর মতো আচমকা ঝড়ের ক্ষেত্রে মাঝি ও পরিচালন সমিতির কর্তারাই সিদ্ধান্ত নেন। এ দিন ঘটনার সময় মাঝগঙ্গায় ওই রুটের আরও একটি নৌকা ছিল। বরাহনগর-বেলুড় রুটেরও দু’টি নৌকা ছিল। কলকাতায় বিবাদী বাগ বা বাগবাজার ঘাট থেকেও এ দিন নৌকা চলেছে। ঝড়বৃষ্টিতে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকেনি। দক্ষিণেশ্বর–বেলুড় রুটের নিত্যযাত্রীরা বলছেন, বছর তিনেক আগে এক সন্ধ্যায় যাত্রীবোঝাই নৌকা উল্টে যাওয়ার পরে দক্ষিণেশ্বর–বেলুড় এবং বেলুড়-বরাহনগর রুটে পুলিশ যাত্রী তোলা নিয়ে কড়াকড়ি করেছিল। তার ফলে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা বন্ধ হলেও খারাপ আবহাওয়ায় নৌকা চলাচল নিয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম লাগু হয়নি।
শহরে এ দিন ঝোড়ো হাওয়ার কারণে মেট্রো চলাচল ব্যাহত হয়। মেট্রোর মুখপাত্র রবি মহাপাত্র জানান, বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ বেলগাছিয়া ও দমদম মেট্রো স্টেশনের মাঝে টানেলের বাইরে ডাউন লাইনে ঝড়ে একটি গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। মিনিট পনেরো পরে মেট্রো কর্মীরা তা সরিয়ে দিলে মেট্রো চলাচল স্বাভাবিক হয়। উত্তর শহরতলির নানা জায়গাতে ঝো়ড়ো হাওয়ার সঙ্গে বাজ পড়েছে। কলকাতা ও দক্ষিণ শহরতলিতেও জোরালো বৃষ্টি হয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানান, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া এলাকায় একটি সক্রিয় নিম্নচাপ অক্ষরেখা ও ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে। তাতে আগামী দু’দিনও ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকছে।