সত্যনারায়ণ খানের সেই বাড়ি। শুটিংয়ের সময় এই বাড়িতেই থাকতেন উত্তমকুমার। ছবি: সুব্রত জানা।
এলাকার বাসিন্দারা যেন এক জন সত্যনারায়ণ খানকে খুঁজছেন! পাঁচের দশকে যে সত্যনারায়ণ টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ার ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন এলাকায়, যাঁর সিনেমার হাত ধরে এ তল্লাটে পা পড়েছিল মহানায়ক উত্তমকুমারের, সুচিত্রা সেনের, জয়া ভাদুড়ির বা নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের, যাঁর উদ্যোগে গ্রামের রাস্তা পাকা হয়েছিল, গড়ে উঠেছিল কলেজ, হাইস্কুল, হাসপাতাল— তেমনই কাউকে চাইছেন হতশ্রী হয়ে পড়া জগৎবল্লভপুরের গোহালপোতা।
শহরঘেঁষা গ্রামটির বাসিন্দাদের আক্ষেপ, সে দিনও আর নেই। সেই সত্যনারায়ণবাবুও নেই। গ্রামের কথা ভাববেন কে?
সত্যনারায়ণ ছিলেন এই গ্রামেরই মানুষ। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি তিনি কলকাতায় গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চণ্ডীমাতা ফিল্মস’ নামে সিনেমা তৈরি ও পরিবেশনার ব্যবসা। প্রতি সপ্তাহে গ্রামে আসতেন। গ্রামবাসীদের সঙ্গে এলাকার উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতেন। নিজের সংস্থার অধিকাংশ ছবির শুটিংয়ের জন্যেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন জন্মভূমি গোহালপোতাকে। সেই সূত্রেই গ্রামে আসতেন বাংলা ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
সেই সময়ে সত্যনারায়ণবাবুর তিনতলা বাড়িতে যে সব সুযোগ-সুবিধা ছিল, তা তখন গ্রামে বসে কল্পনাও করা যেত না। বিশাল মাপের ঘর। তার সঙ্গে অ্যাটাচড্ বাথরুম। স্নানের শাওয়ার। বাড়ির নীচের তলার পুরোটা গ্যারাজ। এক সঙ্গে অন্তত চারটি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা ছিল সেখানে। সবই শুটিংয়ের সুবিধার জন্য। মহানায়ক উত্তমকুমার থেকে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়াদেবী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-সহ বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী এই বাড়িতে এসে থেকে গিয়েছেন। শহরের স্বাচ্ছন্দ্য যাতে এখানে এসেও তাঁরা পেতে পারেন, সে দিকে কড়া নজর ছিল সত্যনারায়ণবাবুর। সত্যনারায়ণবাবুর পুত্রবধূ মৃদুলা খান বলেন, ‘‘এখানে কোনও হোটেল ছিল না। শুটিং উপলক্ষে সেই সময়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গ্রামে এলে থাকবেন কোথায়? সে কথা মাথায় রেখেই শ্বশুরমশাই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন।’’
শোভারানি মেমোরিয়াল কলেজ। যা তৈরি হয়েছিল সত্যনারায়ণবাবুর উদ্যোগে। ছবি: সুব্রত জানা।
ছবির লভ্যাংশের টাকা গ্রামোন্নয়নের কাজে লাগানোর কথা ভেবেছিলেন সত্যনারায়ণবাবু। ছবি হিট হয়েছে। সেই টাকাতেই সত্যনারায়ণবাবুর উদ্যোগে গড়ে ওঠে জগৎবল্লভপুর শোভারানি মেমোরিয়াল কলেজ, কিরণময়ীদেবী জুনিয়র হাইস্কুল, জগৎবল্লভপুর বেসিক ট্রেনিং কলেজ, জগৎবল্লভপুর গ্রামীণ হাসপাতাল। গ্রামের রাস্তা পাকা করে দিয়েছিলেন তিনি।
এক সময়ে সত্যনারায়ণবাবু কংগ্রেস থেকে বিধায়ক নির্বাচিতও হন। ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে সব কিছু যেন ঝিমিয়ে পড়ে। তাঁর সদ্য প্রয়াত বড় ছেলে দিলীপ খান ব্যবসার হাল ধরলেও সুদিন আর ফেরেনি। গ্রামে শুটিং কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। আনাগোনা থেমে যায় তারকাদের। উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে। মৃদুলাদেবী বলেন, ‘‘প্রতি সপ্তাহে তিনি গ্রামের বাড়িতে আসতেন। বৈঠকখানায় বসে গ্রামের মানুষের অভাব অভিযোগের কথা শুনতেন। সকাল থেকে কেটলিতে চা ফুটতেই থাকত। কত মানুষ যে আসতেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই!। শ্বশুরের কড়া হুকুম ছিল, সকলকে চা দিতে হবে।’’
সেই মাঠ, যেখানে ‘হাড়ভাঙা’ ও ‘সর্বমঙ্গলা’ ফুটবল টিমের খেলা হয়েছিল। ছবি: সুব্রত জানা।
মহানায়কের গাড়ি ঢোকার জন্য যে রাস্তা এক সময়ে পিচ-বাঁধানো ছিল, আজ তা এবড়ো-খেবড়ো মাটির রাস্তা। গ্রামীণ হাসপাতালের অবস্থাও তথৈবচ। চারদিক আবর্জনায় পরিপূর্ণ। হাসপাতালের পিছনেই যে কানা দামোদরের বুকে নৌকায় ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে উদাসের ভূমিকায় অভিনয় করা উত্তমকুমার শ্যামল মিত্রের গাওয়া কালজয়ী গানে (এমন করে ছিঁড়ল কেনে...) লিপ দিয়েছিলেন, সেটিও হাসপাতালের বর্জ্যে পরিপূর্ণ। হাসপাতাল সংলগ্ন যে মাঠে ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির খেলার দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল সেটিও হাসপাতালের বর্জ্যে পরিপূর্ণ। রোগীদের অভিযোগ, চিকিৎসক সময়ে আসেন না। সপ্তাহে একদিনের বেশি হাসপাতালে ঝাঁট পড়ে না। খাবার অপ্রতুল।
‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির একটি দৃশ্যে জয়া ভাদুড়ি।—ফাইল চিত্র।
হা-হুতাশ শোনা যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে। চাষি সুদর্শন দাস বললেন, ‘‘কী সব দিন ছিল এককালে। নারায়ণবাবু চলে যাওয়ার পরে গোহালপোতা যেন অনাথ হয়ে গিয়েছে।’’ উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেনদের গ্রামের আনাচে-কানাচে আনাগোনা, ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির শুটিং করতে এসে সারা গ্রাম দাপিয়ে বেড়ানো তরুণী জয়া ভাদুড়ি বা দেশি মদের সন্ধানে নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের অলি-গলিতে খোঁজ-খবর করার স্মৃতি এখনও এলাকার প্রবীণদের মনের মধ্যে ভিড় করে। তাঁরা বলছেন, অমন মানুষ আর কোথায় মেলে!
নারায়ণবাবু যে কর্মযজ্ঞ চালিয়েছিলেন তা পরবর্তীকালে আর ধরে রাখা গেল না কেন? স্থানীয় সিপিএম নেতা তথা দলের লোকাল কমিটির সম্পাদক স্বপন মল্লিক বলেন, ‘‘আমি একাধিকবার জগৎবল্লভপুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলাম। আসলে সেই সময়ে পঞ্চায়েতের হাতে টাকা ছিল না। তবে একবার আমি রাস্তায় মোরাম বিছিয়েছিলাম।’’ জগৎবল্লভপুরের বিধায়ক তৃণমূলের আবুল কাশেম মোল্লা বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্পে গ্রামের রাস্তা বানানো হবে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জগৎবল্লভপুর হাসপাতালে উন্নতির জন্য একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হয়েছে। তা জেলা স্বাস্থ্য দফতর মারফত স্বাস্থ্য ভবনে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদিত হয়ে এলেই কাজ শুরু হবে।’’
সুদিন ফেরার আশায় গ্রামবাসীরা।