লাফিয়ে বাড়ছে সোনার দাম। পুজোর মুখে অন্ধকার নামছে ডোমজুড়ে। তিন বছর পরে আবার।
২০১৬-তে নোটবন্দির জেরে মাথায় হাত পড়েছিল ডোমজুড়ের সোনার কারিগরদের। কাজ কমে যাওয়ার ক্ষতি এতদিনে তাঁরা ধীরে ধীরে কিছুটা সামলে উঠছিলেন। কিন্তু ফের ঘা মারল সোনার দর।
মাত্র তিন মাসে প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দাম ৩২ হাজার টাকা থেকে পৌঁছেছে প্রায় ৪০ হাজার টাকায়। বুধবার প্রতি ১০ গ্রাম (২৪ ক্যারেট) পাকা সোনার দাম উঠেছে ৪০ হাজার ২০০ টাকায়। মানুষ গয়না কেনা কমিয়ে দেওয়ায় বরাত মিলছে না কারিগরদের।
ধাক্কা স্বর্ণশিল্পে
তিন মাস আগে সোনার দাম (দশ গ্রাম) ছিল—৩২ হাজার টাকা
এখন দাম- প্রায় ৪০ হাজার
• বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া সোনার গয়না বিক্রি বন্ধ। বরাত মিলছে না কারিগরদের।
• দুশ্চিন্তায় ডোমজুড়ের পাঁচ হাজার কারিগর।
• মাসে ২০ হাজার টাকা উপার্জন নেমে এসেছে পাঁচ হাজারে।
ডোমজুড়ের ঘরে ঘরে সোনার গয়না তৈরির কাজ চলে। সরাসরি অন্তত পাঁচ হাজার কারিগর এর সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন উপকরণ জোগান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন আরও কয়েক হাজার মানুষ। সঙ্কটে পড়েছেন সকলেই। নবকুমার দাসের কারখানায় ৩৫ জন কাজ করেন। প্রতাপ দাসের কারখানায় কাজ করেন ১০০ জন। কিন্তু সব কারিগরকে নিয়মিত কাজ দেওয়া যাচ্ছে না বলে দু’জনেই জানালেন। নবকুমারবাবু বলেন, ‘‘কিছু আংটি ও উপহার সামগ্রীর বরাত পাচ্ছি। হার, বালা, ব্রেসলেটের মতো গয়নার বরাত বন্ধ বললেই চলে। কলকাতার সোনার দোকানের মালিকেরা আমাদের বলছেন, খদ্দের নেই, ফলে, চাহিদাও নেই। রোজ কলকাতায় যাচ্ছি আর হতাশ হয়ে ফিরছি।’’ প্রতাপবাবু বলেন, ‘‘নোটবন্দির পরে সোনার গয়নার ব্যবসা একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় ফের সেই নোটবন্দির সময়ের দুঃস্বপ্নের দিনগুলি যেন ফিরে এল!’’
ডোমজুড়ের কারিগররা কলকাতার বড় বড় সোনার দোকান থেকে নকশা-সহ বরাত এনে কাজ করেন। এর জন্য মজুরি-বাবদ তাঁরা যে টাকা পান, সেটাই তাঁদের লাভ। কিন্তু তাঁদের খেদ, সোনার দামবৃদ্ধিতে কলকাতার দোকানগুলিতে গয়নার খুচরো বিক্রি কমেছে। ফলে, তাঁদের কাজের বরাত প্রায় নেই-ই।
বিশ্বজিৎ দত্ত নামে এক কারিগর বলেন, ‘‘তিন মাস আগেও মাসে কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করেছি। এখন মাসে পাঁচ হাজার টাকা উপার্জন করতেও হিমসিম খাচ্ছি। পুজোয় বাড়ির সবাইকে জামাকাপড় কিনে দিতে পারব কিনা সন্দেহ।’’ অতনু কোটাল নামে আর এক কারিগরের চিন্তা, মাসে মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতনও আদৌ কারখানা-মালিক দিতে পারবেন কিনা!
ডোমজুড়ে কাজ হয় চুক্তির ভিত্তিতে। বড় কারিগরের নিজস্ব কারখানা থাকে। তিনিই কলকাতার বিপণি থেকে বরাত সংগ্রহ করেন। কারখানায় তিনি নিজেও যেমন কাজ করেন, অনেক কারিগরও থাকেন। কারিগররা চুক্তির ভিত্তিতে পারিশ্রমিক পান। কিন্তু কাজ না-থাকায় তাঁরা পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। তবুও তাঁরা কারখানাগুলিতে রোজ হাজিরা দিচ্ছেন। যদি বাজার ওঠে, সেই ভরসায়।
এই দামবৃদ্ধির সঙ্গেই কলকাতার বড় দোকানিদের একাংশের কিছু আচরণ ‘মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ ডোমজুড়ের কারিগরদের। যে আচরণের জেরে নোটবন্দির সময়েও তাঁদের ভুগতে হয়েছিল বলে ওই কারিগরদের দাবি। তাঁরা জানান, বরাত দেওয়ার সময়ে কালকাতার ব্যবসায়ীরা সোনা দিয়ে দেন। সাধারণত ৫০০ গ্রামের গয়না করতে গেলে ৭০০ গ্রাম সোনা প্রয়োজন হয়। বাড়তি ২০০ গ্রাম সোনাও ব্যবসায়ীরা কারিগরকে দিয়ে দেন। বছরের শেষে এর হিসেব হয়। কারিগরদের অভিযোগ, এখন গয়নার চাহিদা না-থাকায় ব্যবসায়ীরা বাড়তি সোনা দিচ্ছেন না। কারখানা চালু রাখতে তাঁদেরই বাড়তি সোনা কিনতে হচ্ছে। কিন্তু তার দাম মিলছে না। একাধিক কারিগর জানিয়েছেন, দোকানদারদের এই শর্ত যাঁরা মানছেন না, তাঁরা কাজ পাচ্ছেন না। নোটবন্দির সময়ে যে সব কারিগর ব্যবসায়ীদের হিসাব বহির্ভূত টাকা ব্যাঙ্কে গিয়ে বদল করার শর্তে রাজি হয়েছিলেন, তাঁরাই কাজ পেয়েছিলেন। (চলবে)