স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের জন্য ভিড়। মঙ্গলবার পান্ডুয়ার তালবোনা রাধারানি স্কুলে। ছবি: সুশান্ত সরকার।
প্রথম পর্যায়ের ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির শেষে হাওড়া জেলায় ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করেছেন ২ লক্ষ ৯৫ হাজার ৯৪৬ জন। এখনও তিনটি পর্যায় বাকি। ফলে, সংখ্যাটা বাড়বে বলেই ধরে নিচ্ছে প্রশাসন। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক মানুষের নিখরচায় চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগের বাস্তবতা নিয়ে সংশয় দেখা গিয়েছে জেলার বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের একটা বড় অংশের মধ্যে। বিরোধী দলগুলি মনে করছে, বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটা তৃণমূল সরকারের ‘সস্তা রাজনৈতিক চাল’।
প্রকল্পটি নতুন নয়। বিশেষ কিছু পেশার মানুষের জন্য ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্প সরকার আগেই চালু করেছে। এ বারে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হল। আগের প্রকল্পটি বিমাভিত্তিক হলেও নতুন যাঁদের অন্তর্ভূক্ত করা হল, তাঁদের জন্য এখনও বিমার সিদ্ধান্ত হয়নি। এখনও পর্যন্ত ঠিক হয়েছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা পরিষেবা মিলবে নিখরচায়। সরকার ওই খরচ মেটাবে। এখানেই সংশয় দেখা দিয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের একটি বড় অংশের মধ্যে।
কেন?
ওই অংশের বক্তব্য, আগের যে প্রকল্পটি চালু আছে, তাতেই চিকিৎসা চালিয়ে তাঁদের লোকসান হচ্ছে। কারণ, সরকার ওইসব অসুখের চিকিৎসার জন্য যে ‘রেট’ বেঁধে দিয়েছে বিমা সংস্থাগুলি তার বাইরে কোনও টাকা দিতে রাজি হয় না। অথচ, যে টাকা দেওয়া হয় তাতে খরচ ওঠে না। ছোট হাসপাতাল ও নার্সিংহোম কোনওমতে কাজ করতে পারলেও বড় বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমের নাভিশ্বাস ওঠে। যেহেতু সেগুলি চালানোর খরচ অনেক বেশি।
তা ছাড়া, গত কয়েক বছর ধরেই আগের ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ডের সুবিধা নিতে বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমে রোগীদের ঢল নেমেছে। সবার জন্য স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প চালু হলে রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে মনে করেন বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের একাংশ। তাঁদের আরও আশঙ্কা, যে হেতু রাজ্য সরকার নিজে নব পর্যায়ে ওই কার্ডধারীদের চিকিৎসা খরচ বহন করার কথা বলেছে, তাই বিপুল খরচ শেষ পর্যন্ত তারা বহন করতে পারবে না। যদিওবা টাকা দেয় তা অনেক দেরিতে মিলবে। তাতে হাসপাতালগুলির কার্যত নাভিশ্বাস উঠবে।
হাওড়ায় মোট ৪০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে চিকিৎসা করানোর জন্য আগে থেকে তালিকাভুক্ত। হাসপাতাল এবং নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের মত হল, সবার জন্য প্রকল্পটি চালু হলে বাড়তি রোগীর চাপ ওই ৪০টি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমের উপরেই পড়বে। অথচ, সময়ে টাকা না পেলেও তাঁদের কার্ডধারী রোগীদের চিকিৎসা করাতেই হবে। নয়তো হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। উলুবেড়িয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিকের আশঙ্কা, এই সঙ্কটে পড়ে অনেক হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে তালা পড়তে পারে।
মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ভবানী দাস অবশ্য বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে তালিকায় নতুন করে হাসপাতাল ও নার্সিংহোম যুক্ত করা হতে পারে।’’
হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ালেই যে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করছেন না বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের একাংশ। তাঁদের পরামর্শ, ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে যে ‘রেট’ করা হয়েছে তার পুনর্বিন্যাস জরুরি। উলুবেড়িয়ার একটি হাসপাতালের মালিক সুশান্ত মাইতি বলেন, ‘‘পিত্তথলিতে পাথরের অস্ত্রোপচারের জন্য যে টাকা দেওয়া হয় তার থেকে প্রকৃত খরচ অনেক বেশি। আবার অস্থি অস্ত্রোপচারের জন্য যে টাকা দেওয়া হয় তার থেকে প্রকৃত খরচ অনেক কম। ঠান্ডা ঘরে বসে খরচের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে এই রেট করা হলে তাতে সামঞ্জস্য থাকে। হাসপাতালগুলিও ক্ষতির মুখে পড়ে না।’’
একইসঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, যে সব বেসরকারি হাসপাতাল ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে চিকিৎসা করাবে তাদের কর ছাড় দিতে হবে। এটা করা হলেও তারা চিকিৎসা খরচ অনেকটা পুষিয়ে নিতে পারবে। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন, ‘‘বিষয়টি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ বিষয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই।’’
বিরোধীরা আবার সবার জন্য ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পকে নির্বাচনী চমক ছাড়া কিছু বলতে রাজি হননি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘একটা অবাস্তব প্রকল্পকে সামনে এনে তৃণমূল নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে। বাস্তবে এই খরচ বহন করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব।’’ একই সুরে কথা বলেছে বিজেপি।
পক্ষান্তরে, গ্রামীণ জেলা তৃণমূল সভাপতি পুলক রায়ের দাবি, ‘‘সবার জন্য স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। মুখ্যমন্ত্রী তা সুনিশ্চিত করতে প্রকল্পটি চালু করছেন। বিরোধী দলগুলিও তাদের সমর্থকদের ফর্ম পূরণ করিয়েছে। এতেই প্রকল্পটির সার্থকতা বোঝা যায়।’’