দূষিত: দূষণের জেরে বাড়ি লাগোয়া পুকুরের জলের রং হয়েছে এমনই। নিজস্ব চিত্র
দু’বছর আগে যা ছিল সবুজ-খেত, এখন সেখানে ঢেউ খেলছে কমলা জল!
সুস্থ গ্রামবাসীদের এখন অনেকেই চর্মরোগে আক্রান্ত। পুকুর থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে মাছ। মরে যাচ্ছে নারকেল গাছ।
দূষণের জেরে মানুষের সর্বনাশের এই ছবি ডোমজুড়ের কাটলিয়া শিল্পতালুক সংলগ্ন মাকড়দহ-১ এবং শলপ-১ পঞ্চায়েতের অন্তত ১০টি গ্রামের। বেসরকারি ওই শিল্পতালুকের ১০টি গ্যালভানাইজ় কারখানার (যে পদ্ধতিতে লোহার বা অ্যালুমিনিয়ামকে আরও উন্নত করা হয়) রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য তরলের জেরেই গ্রামগুলির এই অবস্থা হয়েছে। সেই বর্জ্যের রং কমলা। তা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। নিকাশি না-থাকায় তা জমে থাকছে নানা জায়গায়। নলকূপ থেকে জল আনতে গেলেও সেই কমলা জলেই পা দিতে হচ্ছে গ্রামবাসীকে।
সমস্যার কথা সকলেই জানেন। জানে প্রশাসনও। কিন্তু এখনও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। দূষণের মধ্যেই দিন কাটাতে হচ্ছে গ্রামবাসীকে। শলপের পাইকার ডাঁসি গ্রামের বাসিন্দা বিশ্বজিৎ পণ্ডিতের খেদ, ‘‘আমরা কারখানা মালিকদের কাছে বারবার দূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছি। নিকাশির ব্যবস্থা করারও কথা বলেছি। ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত সমিতির কাছেও দরবার করেছি। কিন্তু পরিস্থিতি যে-কে সেই।’’
ডোমজুড় পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুবীর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা কারখানা-মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের একার পক্ষে নিকাশি ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাঁরা জানিয়েছেন, সরকার কোনও নিকাশি প্রকল্প করলে তাঁরা কিছু টাকা দেবেন। সেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’’ বিডিও রাজা ভৌমিক বলেন, ‘‘পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। বহু মানুষ যে দূষণের শিকার তা আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। কারখানা-মালিকদের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেছি। যে সব কারখানা দূষণ করছে, সেখানে বর্জ্য শোধনের জন্য ‘এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ বসাতে বলা হয়েছে। শীঘ্রই আমরা ওখানে যাব। ওই প্ল্যান্ট যে সব কারখানা বসাবে না, সেখানে তালা মেরে দেওয়া হবে।’’
ওই শিল্পতালুক সূত্রের খবর, অধিকাংশ গ্যালভানাইজ় কারখানা চলছে ওই প্ল্যান্ট ছাড়াই। শিল্পতালুকের কারখানা-মালিকদের সংগঠনের তরফে দেবব্রত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘যে সব কারখানা দূষণ করছে, তাদের ওই প্ল্যান্ট বসানোর জন্য বার বার বলেছি। অল্প কয়েকটি কারখানা সেই ব্যবস্থা করলেও বাকিরা করেনি। আমরা চাই, সবাই নিয়ম মেনে কারখানা চালান। নিয়ম মানা না হলে সেটা প্রশাসনের দেখা উচিত। বেআইনি ভাবে কেউ কারখানা চালালে আমরা তার পাশে নেই সেটা সব সদস্যকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’
হাওড়া-আমতা রোডের পাশেই কাটলিয়া শিল্পতালুক। সেখানে অন্তত ৭০টি কারখানা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি কারখানাই মানুষ ও প্রকৃতির বিপদ ডেকে আনছে। শিল্পতালুক সূত্রেই জানা গিয়েছে, গ্যালভানাইজ় কারখানায় প্রচুর জল, সালফিউরিক-মিউরিক অ্যসিড এবং বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। কাজ হয়ে গেলে অ্যাসিড ও রাসায়নিক মিশ্রিত জল কারখানাগুলি ঢেলে দেয় জমিতে। তা চলে আসে গ্রামে।
পাইকার ডাঁসি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, রাস্তাটুকু শুধু জেগে থাকলেও প্রতিটি বাড়ির চারদিকে মেঝে পর্যন্ত ডুবে আছে কমলা-জলে। বহুদিন চাষ না-হওয়ায় জমি আগাছায় ভরে গিয়েছে। সেই জমিতেও কমলা-জল। এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পাতকুয়ো আছে। সেই জলে বাসন ধোওয়া থেকে শুরু করে গৃহস্থালির নানা প্রয়োজন মেটান গ্রামবাসী। কিন্তু পাতকুয়োগুলির চারদিকও কমলা-জলে ডুবে রয়েছে। সেই জল চুঁইয়ে পাতকুয়য়োতেও পড়ছে। ফলে, পাতকুয়ার জল আর ব্যবহার করতে পারছেন না বাসিন্দারা। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নলকূপের জলই এখন তাঁদের ভরসা।
পদ্ম নস্কর নামে এক মহিলার ক্ষোভ, ‘‘বছর দুই আগে বাড়ি করেছি। বাড়ির গোড়া পর্যন্ত জল। প্লাস্টার খসে বাড়ির ভিত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’’ লক্ষ্ণীকান্ত বটব্যাল জমি কিনেছেন অনেক আগেই। কিন্তু জমিতে জল থাকায় তিনি বাড়িই তৈরি করতে পারেননি। গ্রামের পুকুরগুলিতেও মিশছে কারখানার বিষাক্ত জল। লক্ষ্ণীকান্তবাবু বলেন, ‘‘আমাদের পুকুরে একসময়ে মাছ চাষ হত। কিন্তু দূষিত জল ঢুকে পড়ায় মাছ চাষ বন্ধ। সেই পুকুর এখন আগাছায় ভরেছে।’’
বর্ষায় পরস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। রাস্তাঘাট ডুবে যায়। বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত জল। শেফালি বটব্যাল নামে এক মহিলা বলেন, ‘‘বিষাক্ত জলে হাত-পায়ে ঘা হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবার বর্ষায় এটা হয়। চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা বেরিয়ে যায়।’’
এই দূষণ থেকে কবে মুক্তি মিলবে এই প্রশ্নই ঘুরছে ১০টি গ্রামে।