মাঠ যখন পার্কিং-এর জায়গা। ছবি: মোহন দাস।
পার্কিং তো হয়ই। তার উপর কখনও গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মাঝেমধ্যে আবার দশ-বারো চাকার গাড়িও দাঁড়িয়ে পড়ছে চেকিং-এর জন্য। এই অত্যাচারে ছাল-চামড়া উঠেই গিয়েছে আরামবাগ শহরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ জুবিলি মাঠ।
এই মাঠের এমনই অবস্থা, মহকুমা সুপার লিগ ফুটবল প্রতিযোগিতার খেলাগুলি সরে গোঘাট ও আরামবাগ ব্লকের গ্রামগুলিতে।
আরামবাগ মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত খেলাগুলি ছাড়াও মহকুমার আন্তঃবিদ্যালয় প্রতিযোগিতা এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলি দীর্ঘদিন ধরে এই মাঠেই হয়ে আসছে। এ ছাড়া, মহিলা কলেজ এবং স্থানীয় চারটি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এই জুবুলি পার্ক মাঠে হয়ে থাকে। খেলা আয়োজকদের ক্ষোভ, দেখভালের অভাবে সেই মাঠ এখন পতিত জায়গায় পরিণত হয়েছে। তার উপরেই গত তিন বছর ধরে চলছে অত্যাচার। বর্ষার ভিজে মাটিতেও যেমন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তেমনি দশ-বারো চাকার গাড়িও নেমে পড়ছে চেকিং-এর জন্য। কখনও খেলা চলাকালীন স্থানীয় মাঠ সংলগ্ন চারটি স্কুলের অভিভাবকেরা গাড়ি নিয়ে মাঠের মধ্যে দিয়েই যাতায়াত করছেন।
কেন এই হাল?
দীর্ঘদিন আরামবাগ শহরের প্রাচীন এই মাঠটির মহকুমা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ছিল। সমস্যা শুরু হয় ২০১৩ সাল নাগাদ। ওই বছর আরামবাগ পঞ্চায়েত সমিতি থেকে সংখ্যালঘু ছাত্রীদের জন্য একটি হস্টেল তৈরি করার পরিকল্পনা নেয়। মাপজোক করার সময় ধরা পড়ে মাঠের প্রায় ২৫ শতাংশ ঈদগাহ-এর সম্পত্তি। বাকি ৭৫ শতাংশ পূর্ত দফতরের (সাধরণ)। নতুন ওই মালিকানা নির্দিষ্ট হওয়ার পরে মহকুমা প্রশাসন এবং পুরকর্তৃপক্ষ মাঠের তদারকি ও সংস্কারের দায়িত্ব এড়িয়েছে বলে অভিযোগ। আর মাঠের শরিক ইদগাহ কমিটি ও পূর্তদফতরও মাঠ সংস্কারের ব্যাপারে উদাসীন মনোভাব দেখায় বলে অভিযোগ। এর পরেই প্রাচীন এই মাঠ এখন পতিত জায়গায় পরিণত হয়েছে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা গিয়েছে, মহকুমাশাসকের বাংলোর ঠিক পিছনে দ্বারকেশ্বর নদীর গায়ে জুবিলি পার্ক নামের এই মাঠটি বৃটিশ আমলে সবুজে ভর্তি ছিল। আয়তন ছিল প্রায় ৭০মিটার লম্বা এবং ৫০মিটার চওড়া। মাঠের ধারে ছিল অনেক দেবদারু গাছ। ছিল একটি শৌচাগার ও কিছু কংক্রিটের চেয়ার। খেলাধুলো ছাড়াও সার্কাস, যাত্রা, নানা প্রদর্শনী হতো এই মাঠেই। ১৯৬০ সালের পর থেকে ক্রমশ যোগ হল রাজনৈতিক সভাসমিতি, বইমেলা-সহ সরকারি ও বেসরকারি নানান মেলা। ১৯৯০ সাল নাগাদ স্থানীয় কোর্টপাড়ার পুরনো বিদ্যুৎ অ্যাথলেটিক ক্লাব, বেনেপাড়ার ইউনাইটেড ক্লাব এবং নেতাজি ক্লাব (এখন উঠে গিয়েছে) মাঠটি বাড়িয়ে সংস্কার করার দাবিতে আবেদন করেছিল। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে বাম পরিচালিত তৎকালীন পুরসভা মাঠটি সংস্কার করে। গাছ কেটে, কংক্রিটের চেয়ারগুলি তুলে দিয়ে মাঠের আয়তন বাড়ানো হয়। বেড়ে লম্বায় প্রায় ৯০ মিটার এবং চওড়ায় প্রায় ৭০ মিটার হয়। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা এবং বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, মাঠটির যথাযথ সংস্কার বলতে সেই প্রথম এবং সেই শেষ।
প্রাচীন মাঠের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মহকুমার ক্রীড়াপ্রেমীরা। মহকুমার বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ তথা মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক নয়ন তরফদারের অভিযোগ, ‘‘মাঠটি সংস্কারের দাবিতে আমরা মহকুমাশাসক, বিধায়ক এবং পুরপ্রধানের কাছে বারবার আবেদন করেছি। কিন্তু তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েই দাস সেরেছেন।’’ একই অভিযোগ করেছেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অমল মুখোপাধ্যায়। খানাকুলের স্বপন পাল, গোঘাটের কামারপুকুরের মধুসূদন নন্দীরা। এ প্রসঙ্গে আরামবাগ পুরসভার চেয়ারম্যান স্বপন নন্দী বলেন, ‘‘প্রশাসন মাঠটি আমাদের হস্তান্তর করলে মাঠটি সংস্কারে উদ্যোগী হব।’’
কী বলছে মাঠের দুই অংশীদার?
ঈদগাহ কমিটির সম্পাদক সাজাহান চৌধুরী বলেন, “আমাদের মাঠ সংস্কারের তহবিল নেই। প্রশাসন বা কোনও সংস্থা সংস্কার করলে আমাদের আপত্তিও নেই।’’ আর পূর্ত দফতরের (সাধারণ) সহকারী বাস্তুকার নিরঞ্জন ভড় বলেন, ‘‘আমাদের তরফে কোনওদিন মাঠ সংস্কার করা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মতো ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।’’
ভারপ্রাপ্ত মহকুমাশাসক দেবজিৎ বসু বলেন, ‘‘মাঠটি সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
সেই সিদ্ধান্ত কবে হবে, ততদিনে মাঠের কী হবে— তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ক্রীড়া আয়োজকেরা।