খেলাঘর গড়ছেন ‘পুলিশ কাকুরা’

খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি...না, মনের ভিতরে নয়। থানার মধ্যে। শিশুদের, কচিকাঁচাদের আনন্দ দিতে। যাতে শিশুরা খেলা করতে পারে? ব্যাপারটা ঠিকই, তবে মূল উদ্দেশ্য, থানায় কোনও কারণে এসে পড়া শিশুদের মনের উপরে পুলিশের চিরাচরিত কাজের অনভিপ্রেত প্রভাব যাতে না পড়ে। তাই থানার মধ্যেই খেলাঘর।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৬ ০১:১৪
Share:

ছোটদের জন্য সাজানো হচ্ছে ঘর। বুধবার, বালি থানায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি...না, মনের ভিতরে নয়। থানার মধ্যে। শিশুদের, কচিকাঁচাদের আনন্দ দিতে।

Advertisement

যাতে শিশুরা খেলা করতে পারে? ব্যাপারটা ঠিকই, তবে মূল উদ্দেশ্য, থানায় কোনও কারণে এসে পড়া শিশুদের মনের উপরে পুলিশের চিরাচরিত কাজের অনভিপ্রেত প্রভাব যাতে না পড়ে। তাই থানার মধ্যেই খেলাঘর। একটি-দু’টি নয়, হাওড়া সিটি পুলিশের ১৬টি
থানার প্রতিটিতেই।

কেমন হবে সেই খেলাঘর?

Advertisement

থানার চৌহদ্দির মধ্যেই ছোট একটি ঘর সাজিয়ে তোলা হচ্ছে শিশুদের জন্য। সেখানে থাকবে না কোনও খাকি উর্দি পরা মানুষজন। থাকবে না লাঠি, বন্দুক, দড়ি, হাতকড়া। থাকবে না বাজখাঁই গলায় ধমক। বরং গোটা খেলাঘর জুড়ে শোভা পাবে ছোটা ভীম, ছুটকি, বাঁটুল, ডোরেমন থেকে গোপাল ভাঁড়— এই রকম বহু চরিত্র। যাদের ছোটরা পছন্দ করে, তাদের ছবি। গোটা ঘরটায় রঙের ছড়াছড়ি।

কখনও কোনও শিশুকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসতে হয় পুলিশকে। কখনও কোনও পুরুষ বা মহিলাকে থানায় প্রয়োজনীয় কাজে যেতে হয়, তাঁর সন্তানকে অন্য কোথাও রেখে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে সঙ্গে করে তাকে থানায় নিয়ে যেতে বাধ্য হন। আবার কোনও অপরাধ বা ঘটনার পরে তার সাক্ষী কোনও শিশুর সঙ্গে কথা বলা জরুরি হয়ে পড়ে।

কিন্তু থানার পরিবেশ বহু শিশুর ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন পুলিশ অফিসারদের একাংশ।

আর যে কারণে হাওড়া সিটি পুলিশের শীর্ষকর্তারা মনে করছেন, থানার মধ্যে খেলাঘর ঠিকঠাক তৈরি করতে পারলে থানায় ঢুকলেই বহু শিশুকে ‘পুলিশ পুলিশ, ভয় ভয়’ যেমন চেপে ধরে, তেমনটা হয়তো বন্ধ হবে। অন্তত এর থেকে বেরিয়ে আসা যাবে অনেকটাই। তাঁদের মতে, থানায় এসে খাকি উর্দি দেখেই ভয় সিঁটিয়ে যায় শিশুরা, খেলাঘরে সেটা হবে না।

পুলিশ মানেই যে ভয় নয়, অন্য একটা জগৎও— সেটাই শিশুদের বোঝাতে চাইবেন শান্তিরক্ষকেরা।

শিশুদের জন্য এমন ব্যবস্থা অবশ্য কলকাতা পুলিশে নেই। কেবল টালিগঞ্জ থানা লাগোয়া একটি ঘর করা হয়েছে শিশুদের যত্ন ও দেখভালের জন্য। মূলত রাস্তা থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুদের থানায়
আনার পরে সেই কেন্দ্রে রাখা হয়। তবে কলকাতার অন্যত্র এই ব্যবস্থা নেই। উদ্ধার হওয়া শিশুদের কয়েক ঘণ্টার জন্য রাখতে হলে ওসি-র বাতানুকূল ঘরে নিয়ে গিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখার চেষ্টা হয়, সম্ভব হলে মহিলা পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের নিয়ে যাওয়া হয় কচিকাঁচাদের দেখাশোনা করতে। সে দিক থেকে খেলাঘর পরিকল্পনার মাধ্যমে কলকাতার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেল হাওড়া সিটি পুলিশ।

হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রের খবর, খেলাঘরে রাখা হচ্ছে শিশুদের টেবিল, চেয়ার, বিভিন্ন পুতুল, গাড়ি ও অন্যান্য খেলনা। এ ছাড়াও থাকছে চকোলেট, বিস্কুটের বন্দোবস্ত। বেশি খিদে পেলে প্রয়োজনে ভারী খাবারও দেওয়া হবে। বালি থানার ওসি বিকাশ দত্তের তত্ত্বাবধানে ডিউটি অফিসারের পাশের একটি ঘরে হলুদ রঙের প্রলেপ দিয়ে সেখানে শিল্পীকে দিয়ে আঁকানো হচ্ছে মজার বিভিন্ন কার্টুন চরিত্র। আনা হয়েছে ছোট চেয়ার, টেডিবিয়ার। শিশুদের ওই ঘরে এক জন মহিলা কনস্টেবল ও সিভিক ভলান্টিয়ার থাকবেন। যিনি শিশুদের পরিচর্যা করবেন। তবে সাদা পোশাকে। তিনি যে পুলিশ, সেটা শিশুরা যাতে বুঝতে না পারে।

উদ্ধার হওয়া শিশুদের থানায় এনে কোনও সময়ে অফিসারদের ঘরে বা ওসি-র ঘরে বসিয়ে রাখা হয়। এমনিতেই বাড়ির লোকজনকে কাছে না পেয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে শিশুটি, তার উপরে সব সময়ে তার চোখের সামনে খাকি উর্দি পরা লোকজনকে ঘুরতে দেখে এবং বকাঝকা করতে দেখে সে আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও থানায় বিভিন্ন রকমের মানুষও তাঁদের সমস্যা নিয়ে আসেন, কেউ এসে কান্নাকাটি করেন কেউ আবার চেঁচামেচি করেন। এ সব দেখেও শিশুরা ভয় পায়। থানার পরিবেশ কোনও ভাবেই বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে আদর্শ নয় বলেই মনে করেন মনোবিদেরা।

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, ‘‘পুলিশ মানেই শাসনের চরম পর্যায়। আর শাসন মানেই ব্যথা। এটা শিশুর মানসিকতার পক্ষে ক্ষতিকর। তাই থানায় এমন একটা ঘরে শিশুদের কিছু সময় কাটানোর ব্যবস্থা থাকলে তা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সমর্থনযোগ্য।’’

হাওড়ার পুলিশ কমিশনার দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ বলেন, ‘‘থানায় এসে দড়ি, লাঠি, বন্দুক দেখে একটা বাচ্চা তো ভয় পাবেই। কিন্তু সেটা ওদের জন্য ঠিক নয়। তাই কোনও বাচ্চা যেন আতঙ্কিত না হয়ে পড়ে, তার জন্যই সব থানায় এই ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।’’ প্রতিটি এলাকার থানার পাশাপাশি এই ব্যবস্থা হচ্ছে মহিলা থানা এবং সাইবার ক্রাইম থানাতেও।

এখন যা অবস্থা, তাতে একটি আতঙ্কিত শিশুকে আশ্বাস দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশকে নিতে হয় যে, ‘ভয় পেও না, ভয় পেও না, তোমায় আমি মারব না।’ পুলিশের আশা, খেলাঘর হলে থানায় এসে আর ভয় পাবে না কোনও শিশু।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement