মানবিক: প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন শম্ভু সামন্ত। —নিজস্ব চিত্র
জনাকয়েক কিশোর মাঠের চারপাশে দৌড়চ্ছে। এক দল ছেলে ব্যায়াম করছে। কয়েক জন বল পায়ে কসরতে ব্যস্ত। ঘামে ভেজা শরীরে বাঁশি মুখে সব দিকেই নজর রেখে চলেছেন এক যুবক।
ভদ্রেশ্বরের তাঁতিপাড়ার সবুজ সঙ্ঘ মাঠে ওই ফুটবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা বিষয়ে যথেষ্ট মিল। তাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সংসারের অনটন বা অন্য কোনও সমস্যায় যাতে কারও খেলা বন্ধ না হয়, বাঁশি মুখে যুবকটি তাই তাদের নিয়ে মাঠে পড়ে থাকেন। তাদের মধ্যে খুঁজে বেড়ান নিজের ‘চুরি যাওয়া’ শৈশব-কৈশোর।
বছর বিয়াল্লিশের ‘অনাথ’ ওই যুবকের নাম শম্ভু সামন্ত। শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে পড়াশোনা বা খেলা— কোনও ইচ্ছেই পূরণ হয়নি। এমন দশা যাতে কারও না হয়, সেই চেষ্টাই তিনি করে যাচ্ছেন দু’দশক ধরে। তাঁর কাছে খেলা শিখতে টাকা লাগে না। উপরন্তু নিজের পকেট থেকে তিনি ছেলেদের খেলার সরঞ্জাম কিনে দেন। সকালের ছোলা-গুড় থেকে কারও প্রয়োজনে দুপুরের ডাল-ভাতের ব্যবস্থাও করে দেন।
শম্ভু জানান, চার বছর বয়সে বাবা-মা হাতে একটি খেলনা দিয়ে তাঁকে রাস্তার পাশে বসিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলেন। এক চায়ের দোকানি দু’বেলা খেতে দিতেন। জামাকাপড় দিতেন। রাত কাটত কোনও মন্দিরের চাতালে, কারও বাড়ির বারান্দায়। একটু বড় হয়ে সামান্য পারিশ্রমিক অথবা খাবারের বিনিময়ে কারও বাড়ির নর্দমা বা বাগান পরিষ্কার করেছেন। গাড়িও ধুয়েছেন। ফুটবলের প্রতি ঝোঁকে দুপুর হলেই মাঠে খেলা দেখতে যেতেন। সুযোগ পেলে বল পিটিয়েছেন। এই ভাবেই ফুটবলের অআকখ শেখা।
কিশোর বয়সে রিক্শা চালানো শুরু করেন। এক সময় ইচ্ছে হয়, ছোট ছোট ছেলেদের খেলা শেখাবেন। সেই শুরু। ক্রমে শিক্ষার্থী বাড়তে থাকে। এখন সেই সংখ্যা প্রায় ৪০। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত চলে প্রশিক্ষণ। টোটোর দাপটে রিকশার আয় কমেছে। রিক্শা ছেড়ে শম্ভু এখন ভাড়ায় টোটো চালান। এখনও অবশ্য আয় খুব বেশি নয়। যেখানে টোটো রাখেন, তার পাশের বাড়ির বারান্দায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দেন।
শম্ভুর কথায়, ‘‘বাবা-মায়ের কথা মনে নেই। কেন ওরা আমাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল, তাও জানি না। দুর্দশায় জীবন কাটিয়েছি। মনে হয়, গরিব ছেলেদের খেলার ব্যবস্থা করতে পারলে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ পাব। ছেলেগুলোকে ঘিরেই এখন আমার সব স্বপ্ন।’’ ভদ্রেশ্বরের বাসিন্দা বিজয় শর্মা বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই শম্ভুকে দেখছি। চালচুলোহীন, অনাথ হলেও ওর মতো বড় মনের মানুষ বিরল। নিজের মুখের গ্রাস অন্যের মুখে তুলে দিতে ক’জন পারে!’’ শিক্ষার্থী রোহিত দাস জানায়, অভাবের সংসারে ‘স্যার’ না থাকলে তার খেলাধুলো হয়তো সম্ভব হত না।
খুদে ফুটবলারদের অনেকেই সে কথায় মাথা নাড়ে। তারাও ‘স্যার’ বলতে অজ্ঞান!