উদ্যোগ: শরৎ স্মৃতি উদ্যান পর্যটনকেন্দ্রের শিলান্যাস। ফাইল চিত্র
কোথাও দেখা যাবে আস্ত পুকুর। ঘাটে খেলা করছে দু’টি বড় মাছ। যাদের নাম দেওয়া হবে কার্তিক-গণেশ। কোথাও আবার নির্জন রাস্তার ধার। সেখানে কথা বলছেন দেবদাস ও পার্বতী।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা রামের সুমতি, দেবদাসের মত ছোটগল্প এবং উপন্যাসগুলির আবহ এবং চরিত্র এইভাবেই ফুটিয়ে তোলা হবে পরিবেশ, ছবি এবং মডেলের মাধ্যমে। হাওড়ার বাগনানের সামতাবেড় গ্রামেই শরৎচন্দ্রের বাড়ি। তাঁর বাড়ির কাছেই এই ভাবেই গড়ে তোলা হচ্ছে ‘শরৎ স্মৃতি উদ্যান’।
স্মৃতি উদ্যানটি তৈরি হচ্ছে জেলা পরিষদ এবং বাগনান ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির যৌথ উদ্যোগে। এর জন্য খরচ হবে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। প্রথম পর্যায়ে ৬ কোটি টাকা দিয়েছে জেলা পরিষদ। পরে তারা আরও টাকা দেবে। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এই প্রকল্পে টাকা দেবে বলে জানান বাগনানের বিধায়ক অরুণাভ সেন। একশো দিনের কাজের প্রকল্পেও বেশ কিছু টাকা খরচ করছে পঞ্চায়েত সমিতি। গত ১৫ জুলাই প্রকল্পটির শিলান্যাস হয়। জেলা পরিষদের প্রথম পর্যায়ের টাকা এবং একশো দিনের কাজের টাকায় শিলান্যাসের পর থেকেই প্রকল্পটির প্রাথমিক কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে বলে জানান পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মৌসুমী সেন। তিনি বলেন, ‘‘একশো দিনের কাজের টাকায় জমি ভরাট করা হচ্ছে। তবে এখন বর্ষা নেমে যাওয়ায় কাজ বন্ধ আছে। বর্ষা কেটে গেলে পুরোদমে শুরু হবে।’’ স্মৃতি উদ্যানে থাকবে কথাশিল্পীর বিভিন্ন ছোটগল্প এবং উপন্যাসের চরিত্রের মডেল। রামের সুমতি গল্পের দু’টি মাছ কার্তিক-গণেশের আবহ আনার জন্য খোঁড়া হবে পুকুর। ছাড়া হবে মাছ। এখানে যেসব পর্যটক আসবেন, তাঁদের রাত্রিবাস করার জন্য তৈরি হবে কটেজ, শৌচাগার। ১০০ আসনের ‘মিনি অডিটোরিয়াম’ করা হবে। সেখানে দেখানো হবে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করা সিনেমা। তৈরি হবে একটি সংগ্রহশালা। সেখানে থাকবে শরৎচন্দ্র বিষয়ক নানা তথ্য। গবেষকরা এসে গবেষণাও করতে পারবেন। মৌসুমী বলেন, ‘‘বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য একটি পেশাদার সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক কাজগুলি করে নেওয়া হচ্ছে। বিস্তারিত পরিকল্পনাটি এলেই আসল কাজ শুরু হয়ে যাবে।’’
প্রকল্পটি হচ্ছে রূপনারায়ণের ধারে। এটি কথাশিল্পীর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। বেশ কয়েকবছর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের সার্কিট ট্যুরিজম প্রকল্পের অধীনে এই ধরনেরই একটি প্রকল্প রূপায়ণের উদ্যোগ নিয়েছিল জেলা পরিষদ। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় জমি নিয়ে। তৎকালীন জেলা পরিষদ কর্তারা ঠিক করেছিলেন এটি করা হবে শরৎচন্দ্রের বাসভবন সংলগ্ন জমিতে। কিন্তু জমির মালিকানা আছে শরৎবাবুর উত্তরাধিকারীদের হাতে। তাঁরা তা জেলা পরিষদকে হস্তান্তর করতে রাজি হননি। ফলে প্রকল্পটি ভেস্তে যায়। নতুন পরিকল্পনায় খাস জমিতে প্রকল্পটি করা হচ্ছে। যে জমিতে প্রকল্পটি করা হচ্ছে তার আয়তন চার একর। যেহেতু এটি রূপনারায়ণ ধার, তাই পুরো প্রকল্পটি পরিবেশ-বান্ধব হিসাবে গড়ে তোলা হবে বলে জেলা পরিষদ এবং পঞ্চায়েত সমিতির কর্তারা জানান।
সামতাবেড়ের পাশে গোবিন্দপুরে বিয়ে হয়েছিল শরৎচন্দ্রের দিদি অনিলাদেবীর। দিদির বাড়িতে বেড়াতে আসার সূত্রে সামতাবেড়ে জমি কিনে নিজের দোতলা বাড়ি তৈরি করেন তিনি। এই এলাকার মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন রূপনারায়ণ ছিল ভয়ঙ্কর। এখন অবশ্য সেই নদ অনেকটা সরে গিয়েছে। তাঁর লেখার ঘরটি ছিল নীচের তলায়। রূপনারায়ণের দিকে ছিল কাঁচের বড় জানালা। লেখার ফাঁকে কথাশিল্পী তাকিয়ে থাকতেন রূপনারায়ণের দিকে। এই বাড়িতে থাকাকালীন তিনি লেখেন ‘বিপ্রদাস’, ‘শ্রীকান্ত চতুর্থ পর্ব’, ‘পথের দাবি’-র মত উপন্যাস। ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধ মালার কয়েকটি প্রবন্ধ। জীবনের শেষ ১২টি বছর তিনি এখানে ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিযুগের বহু বিপ্লবী এখানে এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সামতাবেড়ের পরে কলকাতায় একটি বাড়ি করলেও সেখানে তিনি থাকতেন কালেভদ্রে। ১৯৩৮ সালে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে আমৃত্যু এই বাড়িতে বসবাস করেছেন স্ত্রী হিরণ্ময়ীদেবী।
এখন বাড়িটি জেলার অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রতিবছর পাশের পানিত্রাস হাইস্কুল মাঠে আয়োজিত হয় শরৎমেলা। ফি বছর বহু মানুষ এখানে আসেন। জেলা পরিষদের সহ সভাধিপতি অজয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রকল্পটি রূপায়িত হলে তা রাজ্যের অন্যতম সেরা পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে।’’