তর্ক-বিতর্ক: চা খেতে খেতে রাজনীতির আলোচনা। নিজস্ব চিত্র
বুধবার বেলা ১১টার নাগাদ চা হাতে আড্ডা শুরু হল। কাপে চা ঢালতে ঢালতে ধরতাই দিলেন গৌর ঘোষই। বললেন, ‘‘ভোট যত যত এগিয়ে আসছে কুকথার ঝড় উঠেছে। নকুল দানা, পাঁচন এ সব তো ছিলই। কাল আবার শুনলাম লোকসভার এক প্রার্থী বুথ দখল করতে এলে প্রতিপক্ষের বুকে গুলি করার কথা বলছেন। মহিলাদের আঁশবঁটি নিয়েও তৈরি থাকতে বলছেন। এ সবে তো কান পাতা দায়।’’
এই কথাটারই বোধহয় হয় সকলে।
শঙ্কর ঘোষ (ব্যবসায়ী): এ সব বলে আর কী হবে গৌরদা। এখন যা চলছে তাকে কি আর রাজনীতি বলা চলে? যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতা দখল করতে হবে। এটাই মূল কথা। এই সব কুকথা শুনতে হবে, এ আর নতুন কী!
তপনমণি মুখোপাধ্যায় (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী): আসলে কী জানো তো শঙ্কর, রাজনীতিতে গুণী মানুষের বড় অভাব। একটা সময়ে সংসদে কারা যেতেন? হীরেন মুখোপাধ্যায়, ভূপেশ গুপ্ত, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মত মানুষেরা। তাঁরা সংসদের মর্যাদা বাড়াতেন। সংসদে তাঁদের বক্তৃতা শোনার জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকতেন। তাঁরা যখন মাঠেঘাটে বক্তৃতা পেশ করতেন, তাও ছিল শোনার মতো। এখনকার সাংসদদের মুখের কথা শুনলে তাঁরা মূর্ছা যেতেন!
সোমনাথ গুহ রায় (অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী): একদম ঠিক। এখন আর রাজনীতির সেই মান নেই।
আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শেখ হাসিবুল হোসেন (ব্যবসায়ী): আমার মনে হয়, এখন প্রতিটি দল ক্ষমতা দখলের জন্য যুবকদের রাজনীতির মাঠে টেনে আনতে চাইছে। হালকা কথা বলে যুবকদের মনোরঞ্জন করতে চাইছে। নেতাদের কুকথা তারই ফল। নেতারা ভাবছেন এমন কথা বললে কমবয়সীদের তাতানো যাবে।
সৌমেন্দ্রনাথ চৌধুরী (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী): রাজনীতিতে আজ আর নীতি-আদর্শ বলে কিছু নেই।
শঙ্কর ঘোষ: আসলে রাজনৈতিক পরিবেশটা বিষিয়ে গিয়েছে। একটা সময়ে এত বেশি রাজনৈতিক দল ছিল না। তখন দুটি বা তিনটি প্রধান দল ভোটে লড়াই করত। সেই লড়াই সীমাবদ্ধ ছিল ভোটের সময়েই। এমনও হয়েছে ভোটের দিনে কোনও দলের নেতা বা কর্মীরা বিরোধীদের সঙ্গে বুথে বসে চা খাচ্ছেন বা গল্প করছেন। সে সব ছবি আর কই? এখন কেন্দ্রে বা রাজ্যে যাঁরা শাসক, তাঁরা যে ভাবেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছেন। ফলে কুকথা দিয়ে যতটা জমি-দখলে রাখা যায়, সেই আর কী!
গৌর ঘোষ: আমার দোকানেই তো এককালে ভোটের আগে কত আড্ডা হত! বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা আসতেন। তর্ক হয়েছে কিন্তু কাউকে এমন কথা বলতে শুনিনি যাতে কানে আঙুল দিতে হয়।
তপনমণি মুখোপাধ্যায়: কুকথা বেড়ে যাওয়ার আরও কারণ আছে। কোনও দল নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করছে না। কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দলের কথাই ধরা যাক না। ১৫ লক্ষ টাকা করে অ্যাকাউন্টে এসে যাবে, ২ কোটি বেকারের চাকরি হবে, এইসব প্রতিশ্রুতির কথা আর তারা মুখে আনছে না। কারণ সব ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে। উল্টে জিএসটি, নোটবন্দি করে ছোট ব্যবসায়ীদের সর্বনাশ হয়েছে। নির্বাচনী ইস্তাহারের উপরে ভরসা না করে ব্যর্থতাকে কুকথা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে।
শঙ্কর ঘোষ: রাজ্যের ছবিটাও তো একই। অন্য দলকে সহ্য করার মতো রাজনৈতিক উদারতা শাসক দলের নেই। যেভাবে হোক বিরোধীদের দমিয়ে রাখতে হবে। তাই নকুল দানা, পাঁচন এইসব কথা।
তুষার খেটো (ব্যবসায়ী): যাই বলুন শঙ্করদা, নেতাদের এ সব কুকথা বন্ধ হওয়া দরকার।
অনুপম ঘোষাল (ব্যবসায়ী): নির্বাচন কমিশন কী করছে? নেতাদের মুখ চেপে ধরছে না কেন?
শঙ্কর ঘোষ: কুকথার জবাব নির্বাচনে মানুষই দেবে। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের এটাই শক্তি। না হলে ৩৪ বছরের শাসনের পতন হল কেন? যারা তখন শাসক ছিলেন, রাজত্বের শেষের দিকে কিছু নেতার মুখে কুকথার বান ডেকেছিল। ওই দলের পতন আটকানো যায়নি। মানুষের উপরে আমাদের ভরসা রাখতে হবে। প্রশাসন দিয়ে এসব বন্ধ করা যাবে না।
সকলে মিলে (সমস্বরে): ঠিক ঠিক।