হাসপাতালের দরজায় শুয়ে প্রসব-যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন এক মহিলা। বাড়ি থেকে যে টোটোয় চড়ে হাসপাতালে এসেছেন, সেখান থেকেও তাঁকে নামানো যাচ্ছে না। স্ত্রীকে নিয়ে নাজেহাল অবস্থা স্বামীর। টোটোর মধ্যেই স্ত্রীকে ধরে সাহায্যের জন্য চেঁচিয়ে চলেছেন তিনি। ভিড় করে লোকজন দেখছেন, অথচ কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন না! দেখা নেই হাসপাতালের নার্সদেরও।
শুক্রবার সকালে হাওড়া পুরসভা পরিচালিত লিলুয়ার সিলভার জুবিলি হাসপাতালে এমনই ঘটনার সাক্ষী থাকলেন অনেকেই। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে এসে এ ভাবেই অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়লেন লিলুয়ার পাটুয়াপাড়ার বাসিন্দা পুরুষোত্তমকুমার সিংহ। তাঁর অভিযোগ, প্রসব যন্ত্রণায় স্ত্রী কাতরাচ্ছেন দেখেও হাসপাতাল সাহায্য করেনি। ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখলেও আশপাশের লোকজনও প্রথমে সাহায্য করতে আসেননি। বারবার ডেকেও কোনও নার্সের দেখা মেলেনি। তাঁর দাবি, উল্টে হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল, ‘‘স্ত্রীকে হাসপাতালের ভিতরে আপনাদেরই নিয়ে আসতে হবে। দরজায় গিয়ে কেউ চিকিৎসা করবেন না। অযথা বিরক্ত করবেন না।’’
শেষে টোটোর মধ্যেই পুত্রসন্তানের জন্ম দেন পুরুষোত্তমকুমারের স্ত্রী সবিতা। চিকিৎসার জন্য ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে আসা এক তরুণী সন্তানের জন্ম দিতে সাহায্য করেন সবিতাকে। এখন ওই সিলভার জুবিলি হাসপাতালেই ভর্তি রয়েছে সদ্যোজাত এবং তার মা। হাসপাতাল সূত্রের খবর, বর্তমানে দু’জনেই সুস্থ।
কলেজের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া বৈশাখী ধর নামে ওই তরুণী জানান, ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য তিনি এ দিন হাসপাতালে গিয়েছিলেন। বেরোনোর সময় দেখেন, এক ব্যক্তি কাঁদছেন আর সাহায্যের জন্য চেঁচাচ্ছেন। বৈশাখী বললেন, ‘‘সামনে গিয়ে দেখি, টোটোয় শুয়ে রয়েছেন ওঁর স্ত্রী। পাশে বসা ওই ব্যক্তির বৃদ্ধা মা।’’ জানান, আধশোয়া অবস্থায় অনেকক্ষণ মহিলা টোটোর মধ্যে থাকলেও কেউ সাহায্য করতে আসেননি। এমনই অবস্থা, স্ত্রীকে বৃদ্ধা মায়ের ভরসায় একা ছেড়ে বার বার নার্সদের ডাকতেও যেতে পারছিলেন না ওই ব্যক্তি। বৈশাখীর কথায়, ‘‘ভদ্রলোক আমায় অনুরোধ করেন স্ত্রীকে একটু ধরতে। যাতে তিনি গিয়ে আর এক বার নার্সদের অনুরোধ করতে পারেন। কারণ নার্সেরা কিছুতেই আসছেন না।’’
এর পর সবিতাকে ধরে টোটোয় বসে থাকেন বৈশাখী। তিনি বলেন, ‘‘এক সময় দেখি বাচ্চাটার মাথা বেরিয়ে আসছে। আগে কখনও এরকম দেখিনি। প্রথমে খুব ভয় করছিল। পরে বাচ্চাটা আমার হাতেই হল। ভাবতেই পারছি না দৃশ্যটা।’’ শিশুটির জন্মের পরে হাসপাতাল থেকে নার্সেরা আসেন বলে জানান ওই তরুণী এবং পুরুষোত্তমকুমার।
দীর্ঘ ক্ষণ হাসপাতালের গেটে প্রসব-যন্ত্রণা নিয়ে পড়ে থাকলেও মহিলা সাহায্য পেলেন না কেন? হাসপাতালে যোগাযোগ করে জানা গেল, হাসপাতালের ইন চার্জ চন্দন ভৌমিক ছুটিতে রয়েছেন। পরে ফোনে তিনি বলেন, ‘‘এক জন নার্স গিয়েছিলেন। সম্ভবত নার্সেরা কাজে ব্যস্ত থাকায় যেতে দেরি হয়েছে।’’ হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) ভাস্কর ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘ওই হাসপাতালের কাছে দ্রুত রিপোর্ট চেয়ে পাঠাব। এটা হওয়া উচিত নয়। গাফিলতি থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’’
পুরুষোত্তমকুমার অবশ্য বলেন, ‘‘কিছু হয়ে গেলে কী হত? পরে ব্যবস্থা নিয়ে আর কী হবে? আর কারও সঙ্গে যেন এরকম না ঘটে।’’
তবে এ-ই প্রথম নয়। সম্প্রতি চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের কাছে বিজলি সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন এক মহিলা। পুলিশ মারফত হাসপাতালে খবর গেলেও কোনও চিকিৎসক বা নার্স আসেননি বলে অভিযোগ ওঠে। পরে দোকানদার ও পুলিশের সাহায্যে ফুটপাত কাপড় দিয়ে ঘিরে প্রসবের ব্যবস্থা হয়। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের কর্তারা ওই মহিলা ও তাঁর সন্তানকে হাসপাতালে ভর্তি করান। কর্তারা জানান, ট্রলি হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত তাঁরা দ্রুত নিতে না পারায় পৌঁছতে পারেননি। কয়েক বছর আগে একই ঘটনা ঘটেছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে। সেই সময় ইমার্জেন্সির সামনে প্রসব করেন এক মহিলা। অভিযোগ, হাসপাতালের সাহায্য পাওয়া তো দূর, কয়েকশো মানুষ ভিড় করে প্রসব-দৃশ্য দেখলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। এ দিনের ঘটনা সেই তালিকাই দীর্ঘ করল।