গঙ্গার ধারে সুসজ্জিত ঘাট নিয়েই উঠেছে বিতর্ক। ছবি: তাপস ঘোষ।
কে বলবে গঙ্গার ঘাট! যেন মদের ঠেক!
হুগলির জেলা সদর চুঁচুড়ায় গঙ্গার কাছেই পর পর অতিরিক্ত জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ডিআইজি-র বাংলো। ওই সব বাংলোর বাসিন্দারাই নিয়ন্ত্রণ করেন জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই বাংলোর চার পাশের ছবিটা কেমন? কাছের একাধিক গঙ্গার ঘাটে জমে ওঠে মদের আসর। এমনকী, দেহ ব্যবসাও চলে বলে অভিযোগ। দিনের পর দিন এ সব দেখার কেউ নেই। কী ভাবে পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে এ সব চলে, তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে শহরের অনেক প্রবীণেরই। যাঁদের অনেকেই রাতে গঙ্গার ঘাটে সময় কাটানো বন্ধ করে দিয়েছেন।
মোগলটুলি এলাকার অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী অমল মজুমদারের ক্ষোভ, ‘‘সন্ধ্যায় যে গঙ্গার ধারে গিয়ে অবসর সময় কাটাব, তার জো নেই। একদিকে যেমন কমবয়সী ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিকটূ চলন-বলন, তেমনই একটু রাত বাড়লেই মদ্যপদের উৎপাত। কোথায় যাই! প্রশাসনের উচিত নজর দেওয়া।’’ ধরমপুর এলাকার বাসিন্দা স্বপন সাধুখাঁ এক সময়ে রাতে নিয়মিত গঙ্গার ঘাটে যেতেন। অনেক দিন আসেন না। তিনিও বলেন, ‘‘যখন বয়স কম ছিল, তখন বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে ওখানে বেড়াতে যেতাম। এখন সে অবস্থা নেই। দুষ্কৃতীদের আনাগোনা, মদ্যপদের অত্যাচারে ও দিকে যাওয়া যায় না।’’
জেলাশাসকের দফতর ছাড়িয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে সোজা হাঁটা দিলে সামনেই বিস্তৃত মাঠ। মাঠ পেরিয়েই গঙ্গা। ডান দিকে অতিরিক্ত জেলাশাসকের বাংলো। সন্ধ্যা নামলেই ওই মাঠেই বসে যায় ‘আনন্দের হাট’। অভিযোগ, কেউ প্রকাশ্যে, কেউ বা কিছুটা আড়াল খুঁজে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে মদের আসর শুরু করে দেয়। এক শ্রেণির যুবক আবার স্রেফ ঠান্ডা পানীয়ের বোতলে মিশিয়ে নেয় মদ। আলো-আঁধারিতে গঙ্গার পাড়, মাঠের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গিয়ে চলে টানা আনন্দের আয়োজন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়ে। মৌতাতও বাড়ে।
ওই মাঠ লাগোয়া অন্নপূর্ণা ঘাট আছে। সেখানেও একই ছবি। অতিরিক্ত জেলাশাসকের বাংলোর সামনের মাঠ ছেড়ে এসে রেসিডেন্ট কমিশনার ও পুলিশ সুপারের বাংলোর ঠিক পিছন দিকে আরও একটি গঙ্গার ঘাট রয়েছে। এই ঘাটের লাগোয়া এলাকাটি তুলনায় নির্জন। সেই কারণে এখানে সন্ধ্যার পর যারা নেশার করতে আসে, তাদের কোনও সংকোচ থাকে না। খোলাখুলি বসে যায় নেশার আসর। এই এলাকা ছেড়ে হুগলি জেল চত্বর, চকবাজারে জেলাশাসকের বাংলো লাগোয়া এলাকা, চুঁচুড়া স্টেশন রোড, খাদিনা মোড় এলাকাতেও অবস্থাটা কম-বেশি একই। শহরের ব্যস্ততম এলাকা চুঁচুড়ার প্রাণকেন্দ্র ঘড়ির মোড়ের অদূরে আদালত চত্বরের আলো-আধাঁরি বা হাসপাতাল যাওয়ার পথেও পুলিশের নাকের ডগায় অবাধে মদের ঠেক চলে বলে অভিযোগ।
শুধু এই নেশার আসরেই রাত শেষ হয় না। অভিযোগ, গঙ্গার উল্টো পাড়ে, উত্তর ২৪ পরগনার দিক থেকে লঞ্চ পেরিয়ে জেলা সদরে চলে আসেন বেশ কিছু যৌনকর্মী। গঙ্গার পাড়ে অন্ধকারের আড়াল খুঁজে তাঁরা ‘খদ্দের’ জুটিয়ে নেন। শহরের অনেক প্রবীণেরই অভিযোগ, পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতার জন্যই গঙ্গার ঘাটগুলির ওই দশা হচ্ছে। ওখানে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ কোনও কাজে আসে না। প্রতিবাদ করলে মদ্যপদের ‘রক্তচক্ষু’ দেখতে হয়। কী বলছে পুলিশ? জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, রাতে ঘাট সংলগ্ন এলাকায় নিয়মিত টহলদারি চলে। অভিযোগ এলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
গত কয়েক মাসে জেলা সদর এবং আশপাশের এলাকায় একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। বাড়ছে চুরিও। পুলিশ যেখানে প্রকাশ্য মদের আসরি বন্ধ করতে পারে না, সেখানে এই সব অপরাধ কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে, সে প্রশ্নও তুলছেন ভুক্তভোগীরা। পরিসংখ্যান দেখিয়ে জেলা পুলিশ দাবি করছে, চুঁচুড়া-সহ গোটা জোলায় গত দু’মাসে ২৪২ জন দুষ্কৃতী ধরা পড়েছে।
কিন্তু চুঁচুড়া ফুলপুকুর এলাকার প্রবীণ শিক্ষক সনৎ রায়চৌধুরীর প্রশ্ন, ‘‘শুকনো পরিসংখ্যান দিয়ে কী হবে?’’ একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘আমরা চাই শহরে যেন অপরাধ কমে। রাতে গঙ্গার ঘাটে যেন নির্বিঘ্নে সময় কাটানো যায়।’’ একই দাবি শোনা গিয়েছে আরও অনেকের মুখে।
এখন দেখার, সাধারণ মানুষের সেই চাওয়া কোন পথে পূরণ হয়।