ক্ষয়: এ ভাবেই ভেঙে যাচ্ছে রূপনারায়ণের পাড়। ছবি: সুব্রত জানা
বিপদের নাম ‘চোরাস্রোত’।
নাব্যতা কমেছে অনেক দিন। কিন্তু পাড় ঘেঁষে চলা রূপনারায়ণের চোরাস্রোতের (ডিপ চ্যানেল) ধাক্কায় গত কয়েক বছরে হাওড়ার পাঁচ ব্লকের (আমতা-২, বাগনান-১ এবং ২, শ্যামপুর-১ এবং ২) বহু জমি, বসতবাড়ি নদের গর্ভে চলে গিয়েছে। ক্ষতি হচ্ছে চাষের। ভাঙনের কবলে পড়েছে আমতা-২ ব্লকের ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান এবং ভাটোরা—দুই পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকা। কয়েক বছর আগে পানিত্রাসের সামতাবেড়ে ভাঙনের জেরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িও তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সব জায়গাতেই সেচ দফতর বোল্ডার দিয়ে পাড় বাঁধাচ্ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলে দাবি ‘রূপনারায়ণ বাঁচাও কমিটি’র। মঙ্গলবার থেকে এই কমিটির উদ্যোগে নদ বাঁচাতে শুরু হয়েছে পদযাত্রা।
রূপনারায়ণের উৎপত্তি হুগলির খানাকুল বন্দর থেকে। এখানে শিলাবতী নদী এবং দ্বারকেশ্বর নদ মিশেছে। দুই নদনদীর মিলিত স্রোতই রূপনারায়ণ নামে হাওড়ার উপর দিয়ে এসে গাদিয়াড়ায় গঙ্গার সঙ্গে মিলেছে। বন্দর থেকে গাদিয়াড়া পর্যন্ত রূপনারায়ণের দৈর্ঘ্য ৭৫ কিলোমিটার। তার মধ্যে হাওড়ার অংশ ৫০ কিলোমিটার। খানাকুলের মাড়োখানার পর রূপনারায়ণ ঢুকেছে হাওড়ায়। এই ৫০ কিলোমিটার অংশের বেশির ভাগ পড়েছে চোরাস্রোতের কবলে।
শুধু ভাঙনেই গ্রামবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, নদের খালে বাড়তি জল ঢুকে ভাসিয়ে দিচ্ছে খেত। চাষিদের অভিযোগ, খালগুলি দীর্ঘদিন সংস্কার হয়নি বলেই পাড়ের দিকে এগিয়ে আসা রূপনারায়ণের বাড়তি জল সমস্যা বাড়াচ্ছে। বাগনান-২ ব্লকের দ্বীপমালিতা, বিরামপুর, পানিত্রাস প্রভৃতি এলাকায় বহু জমি ইতিমধ্যেই নদের গর্ভে চলে গিয়েছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে শ্যামপুর-২ ব্লকের ঝুমঝুমি এবং আমবেড়িয়ায়। সঙ্গে নাব্যতা কমে যাওয়ায় ফেরি পারাপারের সমস্যা। নদীতে মাছও সে ভাবে আসছে না।
সেচ দফতরের দাবি, গত কয়েক বছরে রূপনারায়ণের বুকে অনেক জায়গাতেই কচ্ছপের পিঠের মতো চর জেগে উঠেছে। ফলে, মাঝখান দিয়ে আর স্রোত যেতে পারছে না। সেই স্রোত নতুন ‘চ্যানেল’ বেছে নিয়েছে পাড় ঘেঁষে। আর সেটি হয়েছে হাওড়ারই দিকে। ফলে, ভাঙন বাড়ছে। নদের অপর পাড়ে দুই মেদিনীপুরের দিকেও এই সমস্যা হয়েছে। তবে অল্প। এখানে চরের সংখ্যা বেশি।
রূপনারায়ণ বাঁচাতে কী করছে সেচ দফতর? দফতরের জেলা ডিভিশনের এক কর্তা জানান, সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ড্রেজিং করে খুব একটা লাভ নেই। কারণ, যে দিন ড্রেজিং করা হবে, তার কয়েক দিনের মধ্যেই ফের জায়গাটি বালিতে ভরাট হয়ে যাবে। চোরাস্রোতকে পাড়ের দিক থেকে সরিয়ে দিতে ভাঙনের জায়গাগুলি শক্তপোক্ত ভাবে বাঁধানো হচ্ছে। যাতে তাতে ধাক্কা খেয়ে চোরাস্রোত মাঝখানে সরে যায়।
কিন্তু তাতে কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে ‘রূপনারায়ণ বাঁচাও কমিটি’। তাদের দাবি ড্রেজিং এবং নদী সংলগ্ন খালগুলির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার। মঙ্গলবার বাগনানের বাকসি থেকে কমিটির উদ্যোগে নদের বাঁধ ধরে শুরু হয়েছে ৫০ কিলোমিটারের পদযাত্রা। গাদিয়াড়ায় তা শেষ হবে আগামী ৩০ নভেম্বর। ওইদিন গাদিয়াড়ায় সমাবেশও হবে। কমিটি তৈরি হয়েছে মূলত সিপিএমের কৃষকসভার উদ্যোগে। যদিও পদযাত্রায় ওই সংগঠনের কোনও পতাকা বা ফেস্টুন রাখা হয়নি। এ দিন পদযাত্রায় শামিল হন সিপিএমের জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার, দলের নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী প্রত্যুষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। কমিটির আহ্বায়ক পরেশ পাল সারা ভারত কৃষকসভার জেলা সম্পাদক। নদে ড্রেজিং এবং খাল সংস্কারের জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারকে এগিয়ে আসার দাবি তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘রূপনারায়ণের বিপদের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে এবং সংস্কারের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছি। এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। আমরা চাই দলমত নির্বিশেষে সবাই আমাদের সঙ্গে শামিল হন। নাব্যতা কমে যাওয়ায় হাওড়ার দিকে এই নদ যে ভাবে সরে আসছে, তাতে বহু জনপদ চরম বিপদে পড়তে চলেছে। বোল্ডার ফেলে কোনও লাভ হবে না।’’
আমতার কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্রও বলেন, ‘‘ড্রেজিংই রূপনারায়ণের ভাঙনের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র স্থায়ী পথ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এটা দেখা দরকার।’’ তৃণমূল শাসিত আমতা-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুকান্ত পাল বলেন, ‘‘বহু জায়গায় রূপনারায়ণের পাড়ের ভাঙন হচ্ছে। তা বোল্ডার ফেলে রোধ করা যাচ্ছে। নদী সংলগ্ন খালগুলিও আমরা সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছি। ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে তা কেন্দ্রকেই করতে হবে।’’